ছোটবেলায় বাণী বসু চেয়েছিলেন বাসন মাজার কাজের লোক হতে। হ্যাঁ মশাই, 'মৈত্রেয় জাতক', 'অষ্টম গর্ভ', 'গন্ধর্বী', 'মেয়েলি আড্ডার হালচালের'-র মতো কালজয়ী সব উপন্যাসের স্রষ্টা বাণী বসুর মেয়েবেলার এটাই ছিল একমাত্র বাসনা। আসলে, বাড়ির কাজের দিদি, অনিলাদি, এত যত্ন করে পরিপাটি করে বাসন মাজতেন যে, তাই দেখে ছোট্ট বাণী মুগ্ধ হয়ে যেতেন। সেই মুগ্ধতা থেকেই এমন বাসনার জন্ম। ভাবতেন, ভারি ভারি মোটা মোটা বই পড়ে, কঠিন পরীক্ষায় পাশ করে বিদ্যেবোঝাই হওয়া--বাপরে বাপ, তাঁর দ্বারা হবে না!
অল্পদিনেই আর পাঁচজন ভাইবোনের সঙ্গে বিদুষী দিদি গৌরী (ধর্মপাল)-র হাতে তাঁরও শিক্ষার ভার পড়ল। দিদির মুখে দেশবিদেশের লেখকদের গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ শুনতে শুনতে তাঁর চোখে সাহিত্যের ঘোর লাগল। বাল্যের বাসন মাজার ইচ্ছেতে লেখক হবার আকাঙ্ক্ষার পরত পড়ল। ১৯৬২-তে ইংরেজি সাহিত্যে এমএ পাশ করে ভাবলেন, পত্রিকার অফিসে চাকরি নেবেন। এতে চাকরিও হবে, আবার সাহিত্যও হবে। গেলেন আনন্দবাজারের অশোককুমার সরকারের কাছে, 'দেশ' পত্রিকায় যদি ডেস্কজব জুটে যায় এই আশায়। কিন্তু আশায় জল ঢাললেন অশোককুমার। জানালেন, সেখানে মেয়েদের কাজে নেওয়া হয়না। তবে, লিখতে চাইলে বাণী গল্পটল্প লিখতে পারেন।
বাণী বসু এরইমধ্যে একটি গল্প নিয়ে এক লিটল ম্যাগাজিনের অফিসে গেলেন জমা দিতে। সম্পাদকমশাই লেখাটি হাতে নিয়ে ঠোঁট উল্টে ব্যাঙ্গের সুরে বললেন, 'প্রতিভা বসু!' অর্থাৎ কিনা লেখায় লেখিকা প্রতিভা বসুর ছাপ আছে ছত্রে ছত্রে! লেখাটি তিনি ছাপেননি, ছাপতে পারবেন না বলে জানানোর সৌজন্যটুকুও দেখাননি, যে সৌজন্য সেসময়ের রীতি ছিল! এই দোরোখা অপমান মেনে নিতে পারেননি বাণী। তাই সেদিনই ঠিক করেছিলেন লিটল ম্যাগাজিনে কোনদিন লিখবেন না। লেখেনওনি আজ অব্দি। আর তাঁর লেখার ভাষা হবে তাঁরই মতো, কারও প্রভাব থাকবে না। এমনকি তাঁর গদ্য দেখে কেউ বুঝবে না যে, সে কোন নারীর লেখা। এতেও তিনি সফল হলেন। এই নিয়ে মজার গল্পও আছে। সেটা একটু পরে বলছি।
বাণিজ্যিক পত্রিকায় তাঁর প্রথম ছাপা গল্প কিন্তু ছোটদের জন্য লেখা। 'বজ্রপাতের পরে'। প্রকাশিত হয়েছিল নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সম্পাদিত 'আনন্দমেলা' পত্রিকায়, ১৯৮১ সাল নাগাদ। গল্পের নামটা নীরেন্দ্রনাথেরই দেওয়া, কারণ, বাণীর দেওয়া নামটি তাঁর পছন্দ হয়নি; কিন্তু গল্পটি খুব পছন্দ হয়েছিল। আসলে, বাণী তাঁর কাছে ছাপার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন ছোটদের জন্য লেখা একখানা কবিতা। নীরেন্দ্রনাথ জানালেন যে, কবিতা তো আকছারই আসে দপ্তরে, কিন্তু ভালো গল্প কই! ভালো গল্প পেলে ছাপতে পারি। বাড়িতে বাচ্চাকাচ্চা আছে জেনে তিনি বাণীকে খুব উৎসাহ দিলেন ছোটদের জন্য লেখার। বললেন, পারবে, তুমি পারবে! ব্যস, শুরু হল লেখা। এরপর বাণী ধরলেন বড়দের জন্য কলম, শারদীয়া 'আনন্দলোক' পত্রিকায় প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম উপন্যাস 'জন্মভূমি মাতৃভূমি' ১৯৮৭ সালে। আর এই গল্প বা উপন্যাস পড়ে সত্যিই সেদিন কেউ বুঝতে পারেননি যে, এগুলো কোন নারীর লেখা। সে লেখার ছত্রে ছত্রে নিজস্বতার সঙ্গে রয়েছে বলিষ্ঠ পুরুষকার।তাঁরা ভেবেছিলেন, কবি বিষ্ণুচরণ দে যেমন সংক্ষেপে নিজের নাম 'বিষ্ণু দে' করে নিয়েছিলেন, তেমনি বাণীব্রত বা বাণীকুমার নামের কে