ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তন ও সংঘাত-সমন্বয়ে রামমোহন রায়

হুগলির নিষ্ঠাবান বামুন-বোষ্টমের ছেলে কৃষ্ণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। মুর্শিদাবাদে গেলেন নবাবের অধীনে চাকরি করতে। পেলেন 'রায়' উপাধি। কালে কালে এই 'রায়'-ই হয়ে উঠল তাঁর এবং তাঁর বংশের, 'পদবি'। কৃষ্ণচন্দ্রের পরবর্তী প্রজন্ম, ব্রজবিনোদ। তিনি ঘোর বোষ্টম তো বটেই, সেইসঙ্গে মারাত্মক রকমের হিন্দুও। ফলে, বৃদ্ধবয়সে তাঁর যখন মর মর অবস্থা হল, তখন তিনি সেকেলে গোঁড়া হিন্দুর মতো গঙ্গার জলে দেহ ডুবিয়ে মাথাটি পাড়ের মাটিতে রেখে যমদূতের অপেক্ষায় হরিনাম করতে লাগলেন। কিন্তু, যমপুরী থেকে যমদূত আসার আগেই তাঁর কাছে শ্রীরামপুরের চাতরা থেকে এলেন শ্যাম ভটচায। মার্কামারা শাক্ত।

 

আসলে, শ্যাম পড়েছেন মহা-আতান্তরে। তিনি একে ভঙ্গ-কুলীন, তায় আবার মেয়ে তারিণীকে কিছুতেই উদ্ধার করতে পারছেন না। 'ভঙ্গ'-বলে খাঁটি কুলীনরা তাঁকে পাত্তাই দিচ্ছে না, মেয়েকে ঘরে তোলা তো দূরের কথা! ফলে, কুলের ভাঙা কৌলিন্যটুকুও খুইয়ে এবার তাঁর পতিত হওয়ার পালা! প্রাণ থাকতে সে তো আর হতে দেওয়া যায় না! তাই শেষমেশ তিনি চালাকির দ্বারা মহৎ কাজের একটি ফিকির বার করলেন। এবং, সরাসরি মরতে বসা ব্রজবিনোদকে এসে পাকড়াও করলেন। প্রথমেই চেয়ে নিলেন কথা রাখার আশ্বাস। মরণকালে মতিভ্রম হল, তাই ব্রজবিনোদ সেই 'আশ্বাস' দিয়ে বসলেন। ব্যস, এবার নিশ্চিন্ত হয়ে শ্যাম কন্যা-উদ্ধারের আবদারটি সেরে ফেললেন। ব্রজবিনোদের তো সাত ছেলে, কারও না কারও ঘাড়ে তাকে চাপিয়ে দিতেই হবে। উঁহু, না-বললে শ্যাম কিন্তু শুনবেন না! ব্রজ শান্তিতে মরবেন কি, শ্যামের আবদার শুনেই আঁতকে একশা! তেলে জলে মিশ খেলেও খেতে পারে, তাই বলে, বৈষ্ণব-শাক্তে? অসম্ভব! কিন্তু, ওসব যুক্তিতে মরিয়া শ্যাম যাওয়ার বান্দাই নন, তিনি একেবারে যাকে বলে, নাছোড়বান্দা। তাছাড়া তাঁর সঙ্গে রয়েছে মোক্ষম অস্ত্র, 'আশ্বাস', কথা রাখার কথা!

 

সুতরাং, নিরুপায় ব্রজ বাধ্য হয়ে ডাকালেন সাত ছেলেকে। কিন্তু, শাক্ত-সংঘাতে ছয় ছেলেই স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে, বাপের মুখরক্ষার দায় আর যারই থাক তাঁদের অন্তত নেই। বেশ। বাকি রইলেন পঞ্চমপুত্র, রামকান্ত। তিনি নামেও 'রাম', কাজেও তাই। তিনিই একমাত্র 'পিতৃসত্য পালনের জন্য' শাক্তের মেয়ে তারিণীকে বিয়ে করতে রাজি হলেন। অবশ্য, তার মাঝে একটি 'তবে'-ও রইল! তাই ঘরে তোলার আগে তারিণীকে বিধিমতে বিষ্ণুমন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে 'তবে'-ই ঘরে তোলা হল। সদ্য ধর্মান্তরিত বা মতান্তরিতরা সনাতনীদের চেয়ে একটু বেশিই ধর্মপ্রাণ বা মতপ্রাণ হয়ে ওঠেন--এটাই নিয়ম। সেই নিয়মে অল্পদিনেই তারিণী ঘোর বৈষ্ণব হয়ে উঠলেন।

 

রামকান্ত-তারিণীর একটি ছেলে হল। বাপের সঙ্গে মিলিয়ে তাঁর নাম দেওয়া হল, রামমোহন। শিক্ষাই হোক বা ধর্মশিক্ষা শিশুরা নিজের অজান্তেই পরিবার থেকে সে-সব গ্রহণ করতে শুরু করে। রামমোহনের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। বাবা প্রতিদিন গৃহদেবতা রাধাগোবিন্দের পুজো করেন। তারপর ভাগবত পাঠ করে তবেই জলগ্রহণ করেন। বালক রামমোহন তাঁকে দেখে সেটাই অনুকরণ করতে লাগলেন। মাঝে মাঝে তো বাপেরও এককাঠি ওপর দিয়ে যেতে লাগলেন। একাসনে পুরো 'রামায়ণ' পাঠ শেষ করে তবেই আহারগ্রহণ করতে লাগলেন। তাঁর মধ্যে এ-সময় গোপিনীভাব প্রবল হয়ে উঠল। কৃষ্ণপ্রেম এতটাই তীব্র হল যে, রাধাকে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হতে লাগল। মনে হতে লাগল যেন, দু'চোখের বিষ! এ-সময় বাড়িতে একবার 'মানভঞ্জন পালা' অভিনয় করানোর কথা উঠল। কিন্তু, তিনি তৎক্ষণাৎ আপত্তি তুললেন এবং  সটান 'না' করে দিলেন! রামমোহনের তখন কতই বা বয়স, বারো কিংবা তের।

 

বংশপরম্পরায় রামকান্ত মুর্শিদাবাদের নবাবের সেরেস্তায় বেশ উঁচুদরের কর্মচারী। তিনি নিশ্চিত, রামমোহনেরও কোন-না-কোন কাজ এখানে ঠিক জুটে যাবে। তবে, এখানে কাজ করতে হলে যে-দুটো ভাষা জানতেই হবে, তা হল, আরবি এবং ফারসি। সুতরাং, ভালো একজন মৌলবী রেখে রামমোহনের আরবি-ফারসি শেখার পাক্কা বন্দোবস্ত করে দিলেন। সেইসঙ্গে সংস্কৃত শেখানোর জন্যও একজন পণ্ডিতকে রেখে দিলেন। হিন্দুর ছেলে শুদ্ধভাবে যাতে হিন্দুশাস্ত্র পড়তে পারেন, এ-ব্যবস্থা তারই জন্য। ফলে, একইসঙ্গে রামমোহন 'কোরআন শরীফ' এবং 'বেদ-বেদান্ত' পড়ে দেখার সুযোগ পেয়ে গেলেন। আর এসব পড়েই পরম বৈষ্ণব,  ঘোরতর পৌত্তলিক রামমোহনের এতদিনের আস্থা-বিশ্বাস সব ওলট-পালট হয়ে গেল। দুই ভিন্ন ধর্মের  দুই আদিতম ধর্মগ্রন্থেই পেলেন এক-কথা। নিরাকার ঈশ্বর-ব্রহ্মের উপাসনার কথা। একেশ্বরবাদের ভাবনা। উপলব্ধি করলেন এতদিনের পুতুলপুজোর অসারতা। তাই মাত্র ষোল বছর বয়সে মূর্তিপুজোর বিরুদ্ধে 'হিন্দুদিগের পৌত্তলিকতা ধর্ম্মের প্রণালী'-নামে বইও লিখে ফেললেন। যথারীতি বই গেল রামকান্তের হাতে। ছেলের এই অধঃপতনে প্রথমে স্তম্ভিত হলেন, তারপর হলেন দারুণ ক্ষুব্ধ। ধর্ম সম্বন্ধে নিজের নিজের মত নিয়ে বাপছেলে মুখোমুখি হলেন। দুজনেই তেরিয়া, দুজনেই অনড়। ফলে, কাজিয়া উঠল চরমে। শেষ পর্যন্ত রামকান্ত অবাধ্য ছেলেকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন।

 

ষোল বছরের রামমোহন বিতাড়িত হলেন, তবুও বাপের সঙ্গে আপোষ করলেন না। ব্যাপারটা যেন শাপে বরই হল। আপন মনের মালিক হয়ে কিশোর রামমোহন সারা দেশ ভ্রমণ করতে লাগলেন। নানক-দাদুর মতের সঙ্গে পরিচিত হলেন। তিব্বতে গেলেন। সেখানে বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে অনেককিছু  জানার সুযোগ পেলেন। পুরো চার বছরের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি যখন দেশে ফিরলেন, তখন তাঁর বয়স সবে কুড়ি।

 

ছেলেকে বাড়ি থেকে দূর করে দিয়ে এই চার বছরে বাপের হৃদয়টিও কম পুড়ল না। গিন্নির কাছে নিজেকে কম অপরাধী মনে হল না। গোপনে লোক লাগিয়ে ছেলেকে  খুঁজে ফেরানোর চেষ্টাও কম করলেন না। হৃদয় দিয়ে এটাও বুঝতে পারলেন যে, সন্তানের কাছে ওসব ধর্মটর্মের কোন দামই নেই। তাই যখন খবর পেলেন, ছেলে বিভূঁই থেকে ফিরছেন, তখন আর কোন কথা নয়; লোক  পাঠিয়ে তাঁকে সোজা বাড়িতে এনে তুললেন। ধর্মের পর্দা ঠেলে বাপছেলের মান-অভিমানের পর্ব শেষ হল। বাবাই ছেলেকে নিজের ধর্মবিশ্বাস প্রচার ও প্রসারে উৎসাহ দিলেন। তখন নিরাকার ব্রহ্ম-উপাসনার সপক্ষে কলম ধরলেন রামমোহন। শুরু হল জীবনের এক নতুন পর্ব। শুরু হল এক নতুন ধর্ম, 'ব্রাহ্মধর্ম'-র জয়যাত্রা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...