প্রকাশচন্দ্র ও অঘোরবাসিনীদেবীর সংসারটিকে লোকে বলত, 'অঘোর-পরিবার'। পিতৃতান্ত্রিকতার যুগে বাড়ির গিন্নির নামে লোকে পরিবারটিকে চিনছে--এটা ব্যতিক্রম তো বটেই, বৈপ্লবিক ব্যাপারও বলা যায়। পরিবারটি ব্রাহ্ম। ঈশ্বরানুরাগী। এবং, সৎ। আর এই সততা বাপমা হিসেবে প্রকাশ-অঘোর তাঁদের সন্তানদের মধ্যেও চারিয়ে দিতে পেরেছিলেন। এঁদেরই কনিষ্ঠ সন্তানের নাম, বিধানচন্দ্র--বিধানচন্দ্র রায়।
উনিশ শতক শেষ, বিশ শতকের শুরু। বিধানচন্দ্র তখন কলিকাতা মেডিকেল কলেজে এম. বি পড়ছেন। দুই দাদা সুবোধ এবং সাধন--তাঁরা তখনও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছেন। সুতরাং, এসময় একইসঙ্গে তিন ছেলের পড়াশুনার খরচ টানা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল একা প্রকাশচন্দ্রের পক্ষে। স্বাভাবিকভাবেই বিধানচন্দ্র মাসকাবারি যে ক'টা টাকা পেতেন তাতে দিন হয়ত চলে যেত, কিন্তু খুবই কষ্ট হত। থাকতেন ওয়াই.এম.সি.এ হোস্টেলে। এম. বি ছিল পাঁচ বছরের কোর্স। এই পাঁচ বছরে তিনি শুধুমাত্র একবারই পাঁচ টাকা দিয়ে একখানা মেডিকেলের বই কিনতে পেরেছিলেন। বাকিটা তাঁকে লাইব্রেরিতে পড়ে, হাতে লিখে পাঠ সম্পূর্ণ করেছেন। আসলে, অনটনের মধ্যেও মেরুদণ্ড সোজা রেখে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যে মনোবলের প্রয়োজন হয়, তাঁর সেই মনোবল ছিল। উদ্যম, অধ্যাবসায়, নিষ্ঠা ও সততার জন্য তিনি ধীরে ধীরে ব্রিটিশ ও বাঙালি চিকিৎসক-অধ্যাপকদের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। এঁদের মধ্যে শল্যচিকিৎসক কর্ণেল চার্লস, হীরালাল বসু, অধ্যক্ষ বোসফোর্ড এবং কর্ণেল লুকাসের নাম উল্লেখযোগ্য। প্রকৃত শিক্ষক ও সহৃদয় বলেই এঁরা সবাই বিধানচন্দ্রের মতো সম্ভাবনাময় ছাত্রের দিকে তাঁদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধার করার জন্য এঁরা কারুর বাড়িতে শল্যচিকিৎসা করতে গেলে মেল নার্স বা ছাত্র-সহকারী হিসেবে বিধানচন্দ্রকে নিয়ে যেতেন। ফলে, এতে বারো ঘন্টা কাজ করে মাসে মোটামুটি আট টাকার মতো রোজগার করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। তাছাড়া, পিতৃসুলভ স্নেহে অনেক বিজাতি-বিদ্বেষী ইংরেজ চিকিৎসকের হাত থেকেও এঁরা বিধানচন্দ্রকে রক্ষা করেছেন বিভিন্ন সময়ে। এঁরা সবাই শ্রদ্ধেয়, এঁদের সবার কাছেই তিনি ঋণী; তবু, অন্যতম ছাত্রবৎসল সুচিকিৎসক কর্ণেল লুকাসকেই বিধানচন্দ্র আজীবন গুরু বলে মানতেন। তাঁর জন্যই বিধানচন্দ্র একদা হতাশ জীবনে পেয়েছিলেন আলোর দিশা।
এম.বি-র লিখিত ও প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা হয়ে গেছে; ভাইভা হতে দিন পনের বাকি--আর তার মধ্যেই ঘটে গেল ঘটনাটা। কিছুদিন হল ইলেকট্রিক ট্রাম চালু হয়েছে। তা, কলেজ স্ট্রিটের দিক থেকে ঘড় ঘড় আওয়াজ করে একখানা ট্রাম আসছিল। সেই সময় প্রসূতিবিভাগের অধ্যাপক কর্ণেল পেক নিজের ঘোড়ার গাড়িটিতে চেপে মেডিকেল কলেজ থেকে সে-দিকেই বেরুচ্ছিলেন, আর বেরোতে-না-বেরোতেই অমনি কানাত মেরে ট্রামের সঙ্গে ধাক্কা! সেই ধাক্কায় পেক ছিটকে পড়লেন, কোচম্যানও ছিটকে পড়ল। ঘোড়ার গাড়িটি উল্টে পড়ল এবং ভেঙে চৌচির হয়ে গেল। ট্রাম ঘটাং ঘটাং ঘন্টি মারলেও লহমায় ঘটনাটা ঘটে গেল। তবে, এই দুর্ঘটনায় যা হোক পেক, কোচম্যান বা ঘোড়াগুলোর তেমন কিছু হল না। ক্ষুব্ধ পেক মারমুখী হয়ে সঙ্গে সঙ্গে ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। এবং, বিলিতি গালিতে ট্রামের গুষ্টি উদ্ধার করতে লাগলেন। কিন্তু, ওসব গালাগালি গায়ে না-মেখে ট্রামটা যখন চলে গেল, তখন এই দুর্ঘটনার সাক্ষী মানতে তিনি বিধানচন্দ্রের কাছে এলেন। বিধানচন্দ্র গেটের বাইরে একপাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এবং, সবটাই দেখেছেন। পেক বললেন, তুমি দুর্ঘটনাটা দেখেছ, না? বিধান বললেন, হ্যাঁ, স্যার। পেক বললেন, ট্রামটা নির্ঘাত ঘন্টায় তিরিশ মাইল বেগে চলছিল, আমার দৃঢ় বিশ্বাস দুর্ঘটনার জন্য ট্রামটাই দায়ী! আমি ওদের বিরুদ্ধে কেস করব! বিধান বললেন, না স্যার, আমি যা দেখলাম, তাতে মনে হচ্ছে দুর্ঘটনাটা ঘটেছে কোচম্যানের দোষেই। পেক কটমট করে তাকালেন। সত্যটা হজম হল না। ফোঁস করে রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন।
ক'দিন পর পেক ডাক পাঠালেন বিধানচন্দ্রকে। বিধানচন্দ্র গেলেন তাঁর কাছে। পেক সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন যে, তিনি ট্রাম-কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণের মামলা করেছেন, বিধানচন্দ্র তাঁর পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন কি না! উত্তরে বিধানচন্দ্র স্পষ্টই জানালেন, মিথ্যে বলতে তিনি শেখেননি। যা সত্য, তাই বলবেন। সঙ্গে সঙ্গে পেক তেজ দেখিয়ে সাক্ষী-তালিকা থেকে বিধানের নাম খচখচ করে কেটে বাদ দিয়ে দিলেন!
ভাইভা দিতে হলে ঢুকে বিধানচন্দ্র অবাক। পরীক্ষকের আসনে স্বয়ং কর্ণেল পেক। বিধানকে দেখেই তাঁর জোড়া চোখ প্রতিহিংসায় জ্বলে উঠল। ভুলভাল প্রশ্ন করে, চিৎকার করে গায়ের ঝাল ঝেড়ে তাঁকে ঘর থেকে অপমান করে বার করে দিলেন। বর্বর আচরণে মর্মাহত হলেও সততার জন্য বিধানচন্দ্র অনুশোচনা করলেন না বা পেকের কাছে নত হলেন না। জীবনে এই প্রথমবার কোন পরীক্ষায় ফেল করলেন!--এটাও মানতে পারলেন না!
বাবার এত আশা, তাঁর নিজের এত কষ্ট, এত ত্যাগ--তবু, গ্রাজুয়েট হওয়া হল না শুধুমাত্র একজন অসৎ শিক্ষকের জন্য--তাঁর আক্ষেপ এখানেই! বেশ মুষড়ে পড়লেন তিনি। তাঁর পিতৃপ্রতিম শিক্ষকেরা তাঁর উপর যে অনেক আশা করেছিলেন! তাঁরা জানতেও পারবেন না, তিনি কেন পাশ করতে পারলেন না! তিনি বলতে চান, কিন্তু কেমন করে বলবেন!--হতাশা আর দ্বিধাদ্বন্দ্বে যখন বিধানচন্দ্র প্রায় ভেঙে পড়েছেন, সেই মুহূর্তে একজনের হাত আশ্রয় হয়ে এল তাঁর কাঁধে--তিনি কর্ণেল লুকাস। তিনি লোকমুখে কিছুটা শুনেছেন, বাকিটা শুনলেন বিধানচন্দ্রের মুখে। সব শুনে সৌম্য হেসে শান্ত গলায় বললেন, এম.বি-তে অকৃতকার্য হয়েছ তো কী হয়েছে, দুই হপ্তা পরে এল.এম.এস পরীক্ষা আছে--ওটা দাও না। ওটা পাশ করলেই গ্রাজুয়েট হয়ে যাবে। তারপর তো দু'বছর পরেই এম.ডি পরীক্ষা দিতে পারবে; আর তার জন্য এম.বি ডিগ্রি থাকলেই বা কী, না-থাকলেই বা কী! সব ব্যবস্থা আমি করে দেব। ঠিক আছে?--গুরু লুকাস তাঁর উদার আশ্রয়ে শুধু যে বিধানকে হতাশার হাত থেকে ফিরিয়ে আনলেন, তাই নয়; অসতের বিরুদ্ধে সততাকেও জিতিয়ে দিলেন। বাপমায়ের দেওয়া সততার মন্ত্র, বিধানচন্দ্রের কাছে এবার গুরুমন্ত্র হয়ে গেল!