বয়স মাত্র ১১। সেই বয়েসেই আজমগড়ের একটা ছেলে লিখে ফেলেছিল জীবনের প্রথম গজল। গজলে কণ্ঠ দিয়েছিলেন বেগম আখতার। ভারতের গজল সম্রাজ্ঞী।
গ্রামের নাম মিজওয়ান। জমিদার বাড়ির ছেলেটা ছোট থেকেই ভারী অন্যরকম। ঈদের সময় নতুন জামা সে কিছুতেই পরতে চাইত না। গ্রামের যে মানুষগুলো কিছু পায় না, ছেঁড়া জামায় হাজার ফোঁড়ে দিন কাটায় তাদের কথা মনে পড়ত তার।
আতাহার হোসাইন রিজভি। পরে যার নাম হয় 'কাইফি আজমি'। উত্তর প্রদেশের আজম গড়ের মানুষ বলে ‘আজমি’।
বিখ্যাত উর্দু কবি। গীতিকার। চিত্রনাট্যকার। কাইফি আজমির জন্ম হয় ১৯১৮ সালের ১৪ ই জানুয়ারি।
তার এমন অন্যরকম মতিগতি দেখে বাড়ি থেকে তাকে পাঠানো হল লক্ষৌ এর মাদ্রাসায়। কিছুদিনের মধ্যেই সেখানের ছাত্রদের নিয়ে দল তৈরি করে প্রতিবাদে সরব হলেন সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।
বহিষ্কার করা হল তাঁকে সেই প্রতিষ্ঠান থেকে। জমিদার পরিবারে জন্ম হলেও নিজেকে মনেপ্রাণে ‘কিষাণ’ ভাবতেন। কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বারশিপ কার্ড, কিছু মঁ ব্ল্যা ফাউন্টেন পেন। এই ছিল তাঁর সম্পদ। কলমের প্রতি ছিল ভীষণ ভালবাসা ।
১৯ বছর বয়সে যোগ দেন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টিতে। পার্টির কাগজ ‘কউমি জং’ এ লিখতে শুরু করেন। সেই সূত্রেই মুম্বই।
১৯৫২ তে প্রথম সিনেমার জন্য গান লিখেছিলেন। ইসমত চুখতাই এর স্বামী শাহিদ লাতিফের পরিচালনায় 'বু্জদিল'। যদিও গুরু দত্তের পরিচালনায় ‘কাগজ কে ফুল’ তাঁর বড় ব্রেক। ‘শোলা অউর শবনম’, ‘অনুপমা’, ‘আখরি খত’, ‘হকিকৎ’, ‘অর্থ’ এর সফল ছবির গীতিকার তিনি।
ডায়লগ আর স্ক্রিনপ্লে-ও লিখতেন। চেতন আনন্দের ‘হীর রাঞ্ঝা’ চিত্রনাট্য লিখেছিলেন তিনি। ইতিহাস হয়ে আছে সেই সিনেমা।
১৯৭৫ এ 'গরম হাওয়া' ছবির চিত্রনাট্য আর ডায়লগের জন্য জাতীয় পুরস্কার পান। প্রায় চল্লিশটির-ও বেশি ছবির গীতিকার ছিলেন।
লিরিক্যাল দিক থেকে তাঁর সেরা ছবি 'অর্থ'।
বিয়ে করেছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী শাউখাত আজমি কে। তাঁর মেয়ে শাবামা আজমি। অভিনেত্রী। ছেলে বাবা আজমি। সিনেমাটোগ্রাফার।
রূপোলী দুনিয়া, মুম্বইয়ের মায়ানগরীর মোহ কখনও তাঁকে বাঁধতে পারেনি। আরব সাগরের তীর ছেড়ে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন নিজের মাটিতে। মিজওয়ানে। জীবনের শেষ ২০ বছর সেখানেই কেটেছিল। মিজওয়ানকে মডেল গ্রাম করে গড়ে তুলেছিলেন।
তিনি বলতেন, “ আমি পরাধীন ভারতে জন্মেছি। বেড়ে উঠেছি স্বাধীন ভারতে। আর মারা যাব সমাজতান্ত্রিক ভারতে।”
তাঁর জীবন আর দর্শন কখনও আলাদা হয়নি।
বারবার সরব হয়েছেন মানুষের লাঞ্ছনা, মানবিকতার হত্যায়। শুধু ভারতে নয়, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামেও তাঁর কণ্ঠ শোনা গিয়েছিল। তাঁর কলম কথা বলে উঠেছে নির্যাতনের বিরুদ্ধে। মেয়েদের কথা, মেয়েদের যন্ত্রণার কথা তিনি বারবার বলেছেন। হৃদয় দিয়ে লিখতেন। যা বিশ্বাস করতেন তাই লিখতেন।
উত্তরপ্রদেশ সরকার তাঁর সেই অবদানের সম্মানে মেজওয়ান গ্রাম এর মেইন রোড আর সুলতানপুর-ফুলপুর হাইওয়ে তাঁর নামে নামকরণ করেছে। দিল্লি থেকে আজমগড়গামী এক্সপ্রেসটিও তাঁর নামেই।
২০০২ সালের ১০ মে, আজকের দিনে তাঁর কলম চিরতরে থেমে যায়।