‘শান্তিকে সুযোগ দাও’

 

সময়টা ১৯৬৬র নভেম্বর। লন্ডনের ইন্ডিকা গ্যালারি।

সেখানে চলছে এক জাপানি শিল্পীর প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর উদ্বোধনের আগের দিন গ্যালারির কাজ দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল হলের মাঝখানে খাপছাড়া ভাবে একটা লম্বা মই ঝুলছে। বেশ কৌতূহল হল।

মই দিয়ে ওপরে উঠতেই আরও এক বিস্ময়! সিলিং থেকে ঝুলছে একটা দৈত্যাকার আতস কাচ। তাতে চোখ দিতেই স্পষ্ট হয়ে উঠল একটা শব্দ... ‘ইয়েস!’ আর এক জায়গায় লেখা ‘হ্যামার এ নেইল’, যা পাল্টে দিল শিল্পী সম্বন্ধে পুরো ধারণা টাই।

সে সময় শিল্পের সব ক্ষেত্রেই ভাটার টান। নতুন কোন কাজ হচ্ছে না। সবই একই গতানুগতিকে বন্দী। খরার মরসুম। এমন কোনও বোধ জন্ম নিচ্ছে না যা এক ধাক্কায় নাড়িয়ে দেবে চেতনা। বোধের মাটি জলের অভাবে ধুলো ঢাকা। কিন্তু সরকারী হলে এক একজন শিল্পীর প্রদর্শনীতে এই দুই শব্দ আমায় বাকি প্রদর্শনীটি দেখতে বাধ্য করল প্রায়।”

প্রদর্শনীর সেই অচেনা শিল্পীর নাম ইয়োকো ওনো। আর মুগ্ধ দর্শক জন লেনন।

দিনটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেনন পরে বলেন, “ঠিক তখনই সঠিক অর্থে ‘দেখা’

হয়েছিল আমাদের। চোখের তারায় আটকে গেল চোখ। ও যা বোঝার বুঝল। আমিও বুঝলাম, আমার যা বোঝার।”

বাকিটা ইতিহাস। প্রদর্শনীর সেই আলাপ গাঢ় হল ‘বন্ধুত্বে’। বাকি বছরগুলিতে বন্ধুত্ব ঘন হল ‘প্রেমে’। লেনন বিবাহিত। কিন্তু ইয়োকো’র জন্য সমাজ সংসার সব মিথ্যে।

সমাজের চোখে যা অন্যায়, যা পরকীয়া তার জন্য কোনও গ্লানি বা অপরাধবোধ ছিল না দুই শিল্পীর।

বিটলস তখন মধ্যগগনে। ভারতের হৃষীকেশে মহর্ষি আশ্রমে এল রাতা। পুরো বিটলস গ্রুপ একসঙ্গে।

হিমালয়ের ছায়ায় আশ্রমের জীবন। শুরে শোরগোল, চেনা জীবনের জাঁক থেকে অনেক দূরে নিরিবিলি বেঁচে থাকা। কিন্তু প্রতিদিন সেখানেও প্রতিদিন টেলিগ্রাম আসে লেননের কাছে। পাশ্চাত্য থেকে। লেনন চাতক তেস্টায় অপেক্ষা করে টেলিগ্রামের জন্য। হাতে পেলে অন্য মানুষ।

কার টেলিগ্রামের জন্য এমন অধীর অপেক্ষা? সন্দেহ হল স্ত্রী সিন্থিয়ার। তিরটা ইয়োকোর দিকেই। লিভারপুলে ফেরার দু’মাসের মধ্যে সিন্থিয়ার সন্দেহ আর কেবলমাত্র সন্দেহ থাকল না। জন লেননের জীবন থেকে ‘প্রাক্তন’ হয়ে গেলেন তিনি। জনকে ধরে রাখার কোনও চেষ্টাও করেননি। বাঁধ ভাঙা নদীকে আটকাতে পারবেন না জানতেন।

৬৯’- এ বিয়ে করলেন ইয়োকো আর জন। নিজের নাম বদলে জন ওনো লেনন করে নেন। সাড়া জাগালো ‘বেড ইন’। বিশ্বের প্রথম সারির সমস্ত সংবাদ মাধ্যমকে আমন্ত্রণ জানালেন আমস্টারডামে। তাঁদের হোতেলের রুমে। হাত ধরে প্রতিবাদ জানালেন যুদ্ধনীতির বিরুদ্ধে। দুর্বল রাষ্ট্রের ওপর ক্ষমতাবান রাষ্ট্রের আগ্রাসন নীতির ওপর।

জন, তখন আর ‘বিটলস’ তাঁর একমাত্র পরিচয় নয় তাঁর। যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মুখ হয়ে উঠছেন ধীরে ধীরে। ইয়োকো’র সাহচর্য জীবনের বাঁকবদল ঘটাচ্ছে। একসময় বিটলস ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। দল ভাঙানোর অভিযোগ গিয়ে পড়ল ইয়োকোর ওপর। কিন্তু তার কাছে নিজেই প্রতিদিন নতুন করে আবিষ্কার করছেন পৃথিবী বিখ্যাত গায়ক।

সমস্ত নেতি’র উর্ধে উঠে তীব্র আশাবাদে বিশ্বাসী হয়ে উঠছেন। জীবনেকে আঁকড়ে ধরছেন প্রচণ্ড ভালবাসায়। গান লিখছেন। গানের ভাষায় অন্যরকম বদল। সারা পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে লেননের গান। ‘গিভ পিস অ্যা চান্স’, ‘হ্যাপি ক্রিসমাস’- এর মত সব গান।

‘ইমাজিন’ গানের মাধ্যমে যিনি স্বপ্নের পৃথিবীর কথা জানিয়েছিলেন । এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, যেখানে কোনও হিংসা নেই। রাগ নেই। হত্যা নেই। মৃত্যু নেই। ধর্ম নেই।

একই আকাশের তলায় সমস্ত মানুষ শান্তিতে বাঁচবার স্বপ্ন দেখবে। যুদ্ধহীন, বর্ণহীন, বৈষম্যহীন এক মুক্ত পৃথিবী।

১৯৬৯ সালের অক্টোবরে ওয়াশিংটনে প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের মুখে একসাথে উচ্চারিত হয় গানটি। 

বিশ্বশান্তির নতুন ধারা হিসেবে শুরু হল নতুন মতবাদ ‘ব্যাগিজম’। মার্কিন প্রসাশনের রোষে পড়লেন। নিউইয়র্কে ঢুকতে বাধা পেলেন। ফিরলেন ডাকোডায়।

১৯৮০ তে গুলিবিদ্ধ হন লেনন।নিউইয়র্কে তাঁর অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে সেন্ট্রাল পার্ক ওয়েস্টে এক পাগল ভক্ত পরপর চারবার গুলি করে তাঁকে।

গান থামালেন গিটারওয়ালা। মৃত্যুর খানিক আগেই ‘ডাবল ফ্যান্টাসি ফর দ্যা গানম্যান’ এর কপিতে রেখে এসেছিলেন শেষ স্বাক্ষর।

জনের মৃত্যুতে ইয়োকো লিখলেন, “চিরাচরিত প্রথায় জনের অন্তষ্টি হবে না। যে আজীবন মানুষকে ভালবেসে গিয়েছে। তাঁর জন্য সে পথেই প্রার্থনা কাম্য।”

প্রিয় মানুষের অন্তিম অবশেষ টুকু সেন্ট্রাল পার্কের বাগানে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন

লেননের প্রেমিকা।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...