মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তথাকথিত রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের সমাজপতি ছিলেন। তাঁর সমসাময়িক কালে বাংলা সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র ছিল নদিয়া তথা কৃষ্ণনগর। কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র, সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন সহ নানা গুণীজন তার রাজসভা অলংকৃত করতেন। কিন্তু এত গুণের অধিকারী হওয়া সত্বেও সাধারণ মানুষ তাকে "বিশ্বাসঘাতক" বলেছিল। নদিয়ার দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র রায়ের লেখা থেকে জানা যায় যে সাধারণ মানুষ কৃষ্ণচন্দ্রকে "নেমকহারাম" বলে অভিহিত করেছিল কারণ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে কৃষ্ণচন্দ্র ইংরেজদের সহায়তা করেছিলেন। যার পুরস্কার স্বরূপ ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে লর্ড ক্লাইভ কৃষ্ণচন্দ্রকে "রাজেন্দ্র বাহাদুর" উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।
এরপর দেশে ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়। ইংরেজ শাসন কালে নদিয়াতে ইংরেজদের অত্যাচারে রুষ্ট জনসাধারণ বেশ কয়েকটি গণ আন্দোলন সংগঠিত করে। তার মধ্যে নদিয়ার যে আন্দোলন সারা দেশে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল তা হলো "নীল আন্দোলন"...যাকে আমরা "নীল বিদ্রোহ" নামেই জানি। যে নীল বিদ্রোহ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসের একটি বিশেষ অধ্যায় রূপে জায়গা করে নিয়েছে। এই নীল আন্দোলনকে নিয়েই দীনবন্ধু মিত্র লিখেছিলেন তাঁর কালজয়ী নাটক "নীলদর্পণ"।
নীল আন্দোলন দিয়ে যার সূচনা হয় অর্থাৎ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন...সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও নদিয়া জেলার নাম বারবার উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। নদিয়ার নাম গৌরবময় করেছিলেন বাংলামায়ের যে উজ্জ্বল সন্তানরা তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল শহীদ বাঘাযতীন, অনন্তহরি মিত্র, বসন্ত বিশ্বাসের নাম। এঁরা সকলেই নদিয়ার ভূমিপুত্র। গান্ধীজীর নেতৃত্বে ১৯২০ খ্রীস্টাব্দের পর দেশে যে অসহযোগ আন্দোলন গড়ে ওঠে তাতে নদিয়াবাসীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। নদিয়া ধর্ম কর্ম শিক্ষা সংস্কৃতির পীঠস্থান হলেও স্বাধীনতা আন্দোলনে নদীয়ার ভূমিকাকে কোনভাবেই গৌণ বলা যায় না।
বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতির উজ্জ্বল বলয়ে নদিয়ার নামটাও গৌরবময় হয়ে জ্বলজ্বল করছে। শ্রীচৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিলো তা শুধুমাত্র নদিয়াতেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকেনি, সমগ্ৰ বঙ্গভূমিতেই বিস্তৃত হয়েছিল। শুধুমাত্র চৈতন্য মহাপ্রভুর সমকালেই নয়, নদিয়া...বিশেষত নবদ্বীপের শিক্ষা সংস্কৃতির ঐতিহ্য বহু প্রাচীনকাল থেকেই দেশ বিদেশের মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। সাহিত্য, ন্যায়-দর্শন, স্মৃতিশাস্ত্র চর্চা...প্রভৃতির জন্য নবদ্বীপের নাম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। সারা ভারতের বহু জায়গা থেকে ছাত্ররা নবদ্বীপে শিক্ষা লাভ করতে আসতেন। সেই যুগে শিক্ষা এবং সংস্কৃতি চর্চার এমন বিপুল আয়োজন নদিয়া ছাড়া বঙ্গের অন্য কোথাও ছিল না। সুপ্রাচীন বাংলার এই জনপদ শিল্প, শিক্ষা-সংস্কৃতির সর্ববৃহৎ কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। চৈতন্য ভাগবৎ গ্ৰন্থে গ্ৰন্থকার শ্রীবৃন্দাবন দাস লিখেছেন..
.."নানা দেশ হইতে লোককে নবদ্বীপে যায়
নবদ্বীপে করিলে বিদ্যারস পায়"...
নদিয়ার বেশ কয়েকটি মেলাও বিখ্যাত। এই জেলার নানা প্রান্তে বিভিন্ন লৌকিক দেবদেবীর মন্দির রয়েছে এবং তাদের পূজাকে কেন্দ্র করে বসে মেলা। এই মেলাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নবদ্বীপে রাসের মেলা, শান্তিপুরের ভাঙা রাস, কৃষ্ণনগরে বারদৌলের মেলা, ঘোষপাড়ার সতীমার মেলা.. এবং আরো..
এবার আসা যাক শিল্প বাণিজ্যের কথায়। নদিয়ার কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প বা মাটির তৈরি জিনিসপত্র এবং মাটির পুতুলের খ্যাতি জগৎজোড়া। দেশের বিভিন্ন স্থানে তো রপ্তানি হয়ই তাছাড়া বিদেশেও কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল সমাদৃত। পাশাপাশি শান্তিপুর বিখ্যাত তাঁত শিল্পের জন্য। নদিয়ার অর্থনীতি নির্ভর করে আছে এই দুই শিল্পের উপর।
(চলবে)..