১৯৪৭ সালের পনেরোই আগস্ট। ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো। কিন্তু ব্রিটিশদের চক্রান্তে অখন্ড ভারত টুকরো টুকরো হয়ে গেল। তবুও সেই দিন দেশের মানুষ খুব খুশি। কিন্তু আনন্দ নেই শুধু নদিয়াবাসীদের মনে। কেন কেন? কারণ ব্রিটিশদের ভুলে (?) নদিয়া জেলা তৎকালীন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছে। আবার তিনদিন পর সেই ভুল সংশোধিত হয়। ১৯৪৭ -এর ১৮ আগস্ট নদীয়া জেলা আবার ভারত রাষ্ট্রে যুক্ত হয়। হাসি ফোটে নদিয়ার মানুষের মুখে।
নদিয়া জেলার ইতিহাস বহু পুরনো। বল্লাল সেনের আমলে নদিয়াতে ছিল তাঁর রাজধানী। বল্লাল সেনের পিতা বিজয় সেনের রাজত্বকালে নদিয়া অথবা নবদ্বীপ উৎকর্ষের শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিল। সেখানকার শিক্ষা ও সংস্কৃতির কারণে নবদ্বীপ দেশের মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ জনপদের গৌরব অর্জন করে। বিজয় সেনের মৃত্যুর পর রাজা হন বল্লাল সেন। তিনি অত্যন্ত জ্ঞানী মানুষ ছিলেন এবং জ্ঞানী গুণী মানুষদের সমাদর করতেন। তাঁর সময়ে নদিয়ার গৌরব আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল।
বল্লাল সেনের পর তাঁর পুত্র লক্ষণ সেন সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন সেন বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় নদিয়ায় সংস্কৃত সাহিত্য এবং হিন্দু ধর্মের নবজাগরণ হয়েছিল।
কিন্তু লক্ষণ সেনের পর বখতিয়ার খিলজী বঙ্গদেশে মুসলমান শাসনের সূচনা করেন। অর্থাৎ সেন রাজাদের পরেই ১১৯৮ খ্রীষ্টাব্দে নদিয়া মুসলিম শাসনাধীনে চলে যায়। বখতিয়ার খিলজী বেশিদিন শাসন ক্ষমতায় থাকেননি। পরে বাংলায় সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী পাঁচশো বছর এই গৌড়নগর মুসলমান সুলতানদের শাসনাধীন ছিল। পঞ্চদশ শতকে নদিয়ায় নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। এই মহামানবের পুণ্য আবির্ভাব এবং তাঁর ভক্তিবাদ, নতুন ধর্মীয় ভাবধারার প্রচার, সমাজের গোঁড়ামি দূর করে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা - এই সবকিছু নিয়ে একটা নতুন যুগের সৃষ্টি হয়েছিল। বাঙালির রাজনৈতিক অথবা সাংস্কৃতিক ইতিহাসে যে সময়কালকে "চৈতন্য যুগ" বলে বর্ণনা করেছেন ইতিহাসবিদরা।
প্রথম পানিপথের যুদ্ধে বাবর ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করার পর ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। একইসঙ্গে সম্রাট বাবর বাংলার শাসন ক্ষমতা অধিকার করেন। সম্রাট আকবরের শাসন কালে নদিয়ায় রাজবংশের প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ভবানন্দ মজুমদার। তাঁর কথা জানা যায় ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থ থেকে। ভবানন্দ মজুমদার ১৬০৬ খ্রীষ্টাব্দে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের থেকে চৌদ্দটি পরগনার সনদ বা ফরমান লাভ করেন এবং নদিয়ায় রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।ভবানন্দের পূর্ব নাম ছিল দুর্গাদাস সমাদ্দার কিন্তু রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করার পর তার নাম হয় ভবানন্দ মজুমদার অবশ্য পরবর্তীকালে তাঁর বংশধরেরা রায় উপাধি গ্ৰহণ করেন। নদিয়ায় ভবানন্দ মজুমদার রাজত্ব করেছিলেন ১৬০৬ থেকে ১৬২৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। ভবানন্দ মজুমদার নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ থানার ভাটিয়ালিতে তাঁর রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রপৌত্র রাজা রুদ্র রায় তৎকালীন নদিয়া রাজ্যের মাঝামাঝি জায়গায় রেউই গ্ৰামে তাঁর রাজধানী সরিয়ে নিয়ে আসেন এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম অনুসারে রেউই গ্ৰামের নতুন নামকরণ করেন কৃষ্ণনগর। এই রাজা রুদ্র রায়ের পৌত্র হলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় যার রাজত্বকাল ছিল ১৭২৮ থেকে ১৭৮২ (তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত)।
নদিয়া তথা বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন এক উজ্জ্বল বর্ণময় চরিত্র। তাঁর শিক্ষানুরাগী চরিত্র এবং সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতার কারণে তাঁকে ''বাংলার বিক্রমাদিত্য" বলা হতো।
(চলবে)
* নদিয়া জেলা - পর্ব ২