মুর্শিদাবাদ - এই নামটার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ইতিহাস। জড়িয়ে আছে বিশ্বাস এবং বিশ্বাসঘাতকতা, স্বাধীনতার লড়াই এবং পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দী হওয়ার ইতিহাস। আর মুর্শিদাবাদ নামের সঙ্গে যেই মানুষটির নাম এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হয় সেই নামটি হলো সিরাজউদ্দৌল্লা - বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব মনসুর-উল-মুলক সিরাজউদ্দৌলা শাহকুলি খান মির্জা মোহাম্মদ হায়বৎ জঙ্গ বাহাদুর... যাকে আমরা নবাব সিরাজউদ্দৌলা নামেই জানি। আজ তাঁকে নিয়েই একটু আলোচনা করা যাক।
নবাব আলিবর্দী খাঁয়ের দৌহিত্র ছিলেন সিরাজ। আলিবর্দীর তিন কন্যা ছিল... তাঁর কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। সিরাজ ছিল তাঁর তৃতীয় কন্যা আমিনা বেগমের পুত্র। আলীবর্দী খাঁ যেই সময়ে পাটনার শাসনভার লাভ করেছিলেন, সেই সময় (সিরাজ-উদ-দৌলা)-এর জন্ম হয়। তিনি সিরাজের জন্মকে অত্যন্ত সৌভাগ্যের লক্ষণ হিসেবে মনে করে নবজাতককে পোষ্যপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। যেহেতু আলিবর্দী অপুত্রক ছিলেন তাই দৌহিত্র সিরাজকে অত্যাধিক স্নেহ করতেন। যার ফলে সিরাজ একটু বড় হওয়ার পর কিছুটা বিপথে চলে গিয়েছিলেন। যাইই হোক, মাত্র সতেরো বছর বয়সে নবাব আলিবর্দী তাকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেন এবং ঘোষণা করেন যে তাঁর পরবর্তী নবাব হতে চলেছেন সিরাজউদ্দৌল্লা।
কিন্তু আলিবর্দীর এই সিদ্ধান্ত তাঁর স্বজনদের অনেকেই মেনে নিতে পারে নি। তারা সিরাজের বিরোধিতা শুরু করে। এবং ঠিক এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছিল ব্রিটিশরা। তারা চাইছিলই ভারতবর্ষে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে। কিন্তু আলিবর্দী খাঁ এবং সিরাজ ছিল তাদের পথের কাঁটা। ১৭৫৬-তে আলিবর্দীর মৃত্যুর পর বাংলার নবাব হন সিরাজ। তিনি বুদ্ধিমান এবং বীর হলেও তাঁর কিছু ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল তারই রাজ্যের কিছু অতি ধনী ব্যবসায়ী যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জগৎ শেঠ এবং রাজবল্লভ। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সিরাজের সেনাবাহিনীর প্রধান মীরজাফর। এদের সঙ্গেই ব্রিটিশরা সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসন থেকে সরানোর ষড়যন্ত্র করে কারণ ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল যে সিরাজউদ্দৌলাকে কোনোদিন ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করবে না। নিজের সেনাপতি এবং আরো কিছু ক্ষমতালোভী স্বার্থান্ধ কর্মচারী ও ব্যবসায়ীর ষড়যন্ত্র, অতিরিক্ত লোভ এবং বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ক্লাইভের ব্রিটিশ ফৌজের কাছে পরাজিত হন সিরাজ। ১৭৫৭-এর ২৩শে জুন পলাশীর প্রান্তরে অস্তমিত হয় ভারতের স্বাধীনতার সূর্য।
সিরাজউদদৌলা ভাবতেও পারেননি মীরজাফর তাঁর সঙ্গে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে কারণ পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে মীরজাফর শপথ নিয়েছিলো যে, শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে সে ক্ষুণ্ন হতে দেবে না। যুদ্ধে পরাজিত হয়েও সিরাজ আত্মসমর্পণ করেন নি। তিনি তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী লুৎফুন্নিসা এবং কন্যা এবং ভৃত্য গোলাম হোসেনকে নিয়ে ছদ্মবেশে নৌকায় পদ্মা ও মহানন্দার মধ্য দিয়ে উত্তর দিক অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। তার আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছতে পারলে ফরাসি সৈনিক মসিয়ে নাস-এর সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহায়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন। কিন্তু সেখানেও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছিলেন তিনি। তাঁকে চিনতে পেরে মীরজাফরের কাছে ধরিয়ে দিয়েছিল এক লোভী মাঝি/ মতান্তরে এক লোভী ফকির। এই মীরজাফরই সিরাজকে হত্যা করে হয়েছিল ইংরেজদের আজ্ঞাবহ দাস-নবাব। পলাশির যুদ্ধে জয়ের পরই ইংরেজরা ভারতের শাসন ক্ষমতা দখল করে নেয়। ১৭৫৭ সালের ৩রা জুলাই মীরজাফরের আদেশে তাঁর ছেলে মীরন এর তত্ত্বাবধানে সিরাজকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করেছিল মুহম্মদি বেগ নামে এক ঘাতক । কথিত আছে, সিরাজের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোরানো হয়। মুর্শিদাবাদের খোশবাগে দাদামশাই নবাব আলিবর্দী খানের কবরের কাছে কবর দেওয়া হয় আলিবর্দী খাঁয়ের প্রাণাধিক প্রিয় দৌহিত্র সিরাজকে। আজ ও চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতক কোনো মানুষকে বোঝানোর জন্য অতি ঘৃণার সঙ্গে মানুষ মীরজাফর আর জগৎ শেঠ এর নাম উচ্চারণ করে।
যা ঘটেছিল তা তো আর পাল্টানো যায় না। কিন্তু আজও কি মনে হয় না যে শুধুমাত্র কয়েকটা লোভী ক্ষমতাকাঙ্ক্ষী মানুষ যদি অতিরিক্ত লোভের কারণে বিশ্বাসঘাতকতা না করতো তাহলে হয়তো আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি আজ অখন্ড ভারত ই থাকতো। তাকে তিনটে দেশে ভাগ হয়ে যেতে হতো না।
মুর্শিদাবাদ জেলার বেড়ানো এবং ভালো ভালো যা কিছু আছে তার তত্ত্বতালাশ নিয়ে পরবর্তী পর্বেই আসবো।
(চলবে)