বঙ্গভূমির জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়াতে বেরিয়ে (অবশ্যই মানস ভ্রমণ এবং লেখা/পড়ার মাধ্যমে ভ্রমণ। এই সময়টা তো ঠিক বাইরে বেড়াতে যাওয়ার উপযুক্ত নয়। ) এবার এলাম ... সেই জেলাটায় যেই জেলার নামের সঙ্গে একজন নবাবের নাম জড়িত আছে। মনে পড়ছে? নদিয়ার জেলাতুতো ভাইও বলা যেতে পারে এই জেলাকে। এই জেলাতেই গঙ্গা নদী নিজেকে দুভাগে ভাগ করে ফেলেছে... একভাগ পদ্মা নাম নিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে আর আরেকভাগ ভাগিরথী গঙ্গা হয়ে আমাদের দেশে, আমাদের রাজ্যের মধ্য দিয়েই বয়ে গেছে। এবার নিশ্চয়ই মনে পড়লো নামটা? আরে পাঠকবন্ধুগণ, এই জেলাতে এই জেলার নামেই একটি শহর আছে যেখানে সিংহাসনাসীন ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব.... নবাব সিরাজউদ্দৌলা - যাকে পরাজিত করেই এই দেশে ইংরেজরা শাসন ক্ষমতা অধিকার করে নিয়েছিল।
ঠিক ধরেছেন পাঠকবন্ধুরা, এবার বলবো মুর্শিদাবাদ জেলার কথা।
ভাগিরথী নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই জেলার ইতিহাসও বেশ পুরনো। সুবাহ বাংলার দেওয়ান মুর্শিদকুলি খান ১৭০৪ খ্রীষ্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রশাসনিক কার্যালয় মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসেন এবং এই জেলায় বা অঞ্চলে বাস করতে শুরু করেন। তখন কিন্তু এই অঞ্চলের নাম ছিল মুখসুদাবাদ। আবুল ফজল রচিত আইন-ই-আকবরি গ্ৰন্থে ষোড়শ শতকের শেষ দিকে বাংলা এবং বিহারের শাসনের দায়িত্ব পালনকারী মখসুস খান নামক একজন অভিজাত ব্যক্তির উল্লেখ আছে। সম্ভবতঃ সেই অভিজাত মানুষটির নামেই ভাগিরথী তীরবর্তী এই এলাকার নাম হয়েছিল মখসুদাবাদ বা মুখসুদাবাদ। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই এই অঞ্চল রেশম শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে। মুর্শিদকুলি খান ১৭১৬ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার নবাব হওয়ার পর মুখসুদাবাদকে বাংলার রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলেন এবং তাঁরই নামে এই শহরের বা এলাকার নাম রাখেন মুর্শিদাবাদ। নদিয়ার মতো প্রাচীন শিক্ষা সংস্কৃতির ঐতিহ্য না থাকলেও বাংলার রাজধানী এবং অর্থনৈতিক ভাবে অত্যন্ত সমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে মুর্শিদাবাদ প্রসিদ্ধ ছিল। শুধু বাংলার নয়, বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ। নবাব মুর্শিদকুলি খান এর নামানুসারেই পরে এই জেলারও নাম হয় মুর্শিদাবাদ। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে সেইসময় মুর্শিদাবাদ লন্ডন শহরের থেকেও সমৃদ্ধ ছিল। তাঁর সময়ে মুর্শিদাবাদের অতুলনীয় শ্রীবৃদ্ধি ঘটে এবং পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের মূল কেন্দ্রে পরিণত হয়। বাংলার সবথেকে ধনী মানুষরা মুর্শিদাবাদে বাস করতেন। প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কার্যকলাপের মূল কেন্দ্র হওয়ার কারণে অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানগুলিও তাদের প্রধান অফিস বা কার্যালয় মুর্শিদাবাদেই প্রতিষ্ঠা করেছিল। এবং মুর্শিদাবাদ টাঁকশাল বাংলায় বৃহত্তম টাঁকশালে পরিণত হয়েছিল। এই মুর্শিদাবাদেই রাজধানী ছিল বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার যিনি ইংরেজদের বশ্যতা স্বীকার করবার থেকে মৃত্যুকেও শ্রেয় বলে মনে করেছিলেন। পলাশীর যুদ্ধের কথা তো আমাদের অর্থাৎ প্রত্যেক বাঙালিরই জানা। পলাশীর প্রান্তরে সিরাজউদ্দৌলা এবং তাঁর সেনাবাহিনীর সঙ্গে ব্রিটিশ ফৌজের যুদ্ধে শুধু বাংলা নয়, সমগ্ৰ ভারতের ভবিষ্যৎ রচিত হয়েছিল। ১৭৫৭-র ওই যুদ্ধ হেরে গিয়েছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ। ২০০ বছরের জন্য ব্রিটিশদের কাছে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছিল আমার মাতৃভূমি। ১৭৭৩ সালে ব্রিটিশরা মুর্শিদাবাদ থেকে বাংলার রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তরিত করেছিল। তখন থেকেই মুর্শিদাবাদ শহরের বা জেলার সমৃদ্ধি বা গুরুত্ব কমতে শুরু করে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর মুর্শিদাবাদ পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা রূপে ঘোষিত হয় কিন্তু সেই জেলার সদর শহর হয় বহরমপুর।
(চলবে)