১৯৬৩ সাল। বাংলা ভাষা ও সাময়িকপত্রের জগতে দুটো নতুন জিনিস আমদানি করলেন সাহিত্যিক অদ্রীশ বর্ধন। এক, একশো বছর আগে উদ্ভূত ইংরেজি 'সায়েন্স ফিকশন'-শব্দটির সার্থক বাংলা পরিভাষা, 'কল্পবিজ্ঞান'--শব্দবন্ধটি নির্মাণ করলেন। দুই, তাঁর হাতেই আত্মপ্রকাশ করল বাংলা ভাষার তো বটেই, ভারতের প্রথম কল্পবিজ্ঞান-পত্রিকা। আকাশ সেন--ছদ্মনামে তিনি হলেন পত্রিকার সম্পাদক। পত্রিকাটির নাম দিলেন, 'আশ্চর্য'। প্রায় সত্তর বছরের ইতিহাস নিয়ে জগদানন্দ রায়, হেমলাল দত্ত ও জগদীশচন্দ্র বসু'র হাত ধরে বিজ্ঞান ভিত্তিক গল্পের যে ক্ষীণধারাটি বয়ে চলছিল, এই পত্রিকার মধ্য দিয়ে সেই ধারায় যেন জোয়ার এলো। লেখক হিসেবে নিজে তো কলম ধরলেনই, সেইসঙ্গে একে একে প্রেমেন্দ্র মিত্র, ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য, সত্যজিৎ রায়ের মতো বিজ্ঞাননির্ভর গল্পলেখকদের কাছেও গল্প আদায় করে ছাড়লেন। এমনকি বিদেশের বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞানের বিশিষ্ট গল্পগুলোও অনুবাদ করে পত্রিকার পাতায় প্রকাশ করতে লাগলেন। ফলে, অল্পদিনেই কিশোর-কিশোরীমহলে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠল পত্রিকাটি।
বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প বা কল্পবিজ্ঞানের গল্প লেখার ক্ষেত্রে অদ্রীশ বর্ধনের দৃষ্টিভঙ্গিটি ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি বিশ্বাস করতেন, "যে-সব গল্পে স্কুলমাস্টারি হয়েছে--বিজ্ঞান নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে গল্পগুলোকে ছিবড়ে অথবা শুকনো খটখটে করে ফেলা হয়েছে--সে সব গল্প যারা পড়েছে--তারা কল্পবিজ্ঞানের নাম শুনলেই ভয় পায়। ছোটদের গল্প হোক গল্পের মতোই--"। তাই তাঁর গল্পে বিজ্ঞান থাকে গল্পের অস্থিমজ্জায় আর নিটোল গল্পরস হয়ে ওঠে তার আবরণ। তাঁর গল্পের একটি বিশিষ্ট দিক হল, এডভেঞ্চারধর্মিতা। তাঁর রক্তে এই জিনিসটি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন আর এক কিশোর-সাহিত্যিক, শিবরাম চক্রবর্তী। আকৈশোর কাঞ্চন তাঁকে আমূল টেনেছিল। শিবরাম চক্রবর্তীর 'বাড়ি থেকে পালিয়ে'র ছোট্ট নায়ক, কাঞ্চন। সে গ্রাম থেকে কলকাতায় পালিয়ে আসে, তার জীবনের পরতে পরতে ঘটে চলে আশ্চর্য এডভেঞ্চার। শিবরামের বকলমে কাঞ্চন সেই 'আশ্চর্য' এবং 'এডভেঞ্চার'--দুটো জিনিসেরই নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল অদ্রীশের জীবনে। ফলে, তারই টানে তিনি একদিন কলকাতা থেকে পালিয়ে হাজির হলেন বোম্বেতে। শুরু হল বিচিত্র অভিজ্ঞতার দিন। মিলল এক ফ্রেমে অনেক জীবন দেখার সুযোগ। ছাড়লেন-ধরলেন চোদ্দ রকমের চাকরি। দেখলেন, বিচিত্র পেশায় কত বিচিত্র মানুষ। আর এ-সবই একে একে উঠে আসতে লাগল তাঁর লেখা বর্ণময় কিশোর-সাহিত্যে।
অবশ্য এডভেঞ্চার তাঁর জীবনে কোনদিনই থামেনি। বম্বে থেকে চাকরিসূত্রে গেলেন ব্যাঙ্গালোর। তারপর একদিন নিশ্চয়তার চাকরি ছেড়ে ফিরলেন আবার কলকাতায়। বাংলা সাহিত্যে নতুনত্বের স্বাদ আনতে 'আশ্চর্য' পত্রিকা প্রকাশ করলেন। শুধু তাই নয়, সুষ্ঠুভাবে পত্রিকা প্রকাশ করতে নিজের বাড়িতেই দু'জন কম্পোজিটর রেখে ছাপাখানা বসিয়ে ফেললেন। সারা দেশের বাংলাভাষী মানুষের কাছে পত্রিকাটি পৌঁছে দিয়ে কল্পবিজ্ঞানের প্রসার ঘটাতে অমানুষিক পরিশ্রম শুরু করলেন। বড়-মাঝারি রেল-স্টেশনে থাকে 'এ এইচ হুইলার'-এর বইয়ের দোকান। সেখানে পত্রিকাটি রাখার ব্যবস্থা করতে কলকাতার অফিসে ধরণা দিলেন। কাজ হল না। তখন কলকাতা থেকে স্কুটার নিয়ে ছুটলেন এলাহাবাদের অফিসে। ফিরলেন একেবারে ব্যবস্থা পাকা করে। এক বছরের সন্তান রেখে স্ত্রীর অকালমৃত্যু ঘটল। ছেলেকে একলা বুকে মানুষ করলেন তিনি। জীবনের টালমাটালে 'আশ্চর্য' বন্ধ হল। সত্যজিৎ রায় ও প্রেমেন্দ্র মিত্রকে নিয়ে ছোটদের বাছাই করা সায়েন্স ফিকশন ছবি দেখানোর জন্য 'সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাব' তৈরি করলেন। নতুন উদ্যমে একসময় কল্পবিজ্ঞানবিষয়ক আরেক পত্রিকা বার করলেন। নাম দিলেন, 'ফ্যান্টাস্টিক'। তাতে লিখতে লাগলেন সেকালের নবীন লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ প্রমুখেরা। শেষমেশ আপামর কিশোর-কিশোরীদের মজ্জায় কল্পবিজ্ঞানের রসপ্রবাহ বইয়েই ছাড়লেন। একজীবনে এ-তো কম কথা নয়! আসলে, তাঁর মধ্যে এক অদ্ভুত উদ্দামতা ছিল। তারই জন্য তাঁর জীবনে 'ভেঞ্চার' আর 'এডভেঞ্চার' মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
তথ্যঋণ : 'কল্পবিশ্ব পত্রিকা'- অদ্রীশ বর্ধন বিশেষ সংখ্যা।