রবীন্দ্রনাথ-নেতাজি সংলাপ

বাঙালির দুই প্রবাদ পুরুষ একজন নেতাজি আর আরেকজন রবীন্দ্রনাথ, আজও আমাদের জাত্যাভিমান এই দু'জনের উপরেই ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। রবি-সুভাষ আমাদের অস্মিতা, আমাদের অহংকার। তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত স্নেহ ও শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল। স্বয়ং রবি ঠাকুর সুভাষকে দেশনায়ক বলেছিলেন। স্বদেশের বুকে নতুন প্রাণ সঞ্চার করার জন্য, "তাসের দেশ" উৎসর্গ করেছিলেন সুভাষকে।

আবার সুভাষ চন্দ্রও পরম শ্রদ্ধাশীল ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রতি। ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরের ক্যাথে সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে প্রতিষ্ঠিত হয় আজাদ হিন্দ সরকারের অর্থাৎ ভারতের প্রথম স্বাধীন ভারতীয় সরকার৷ আজাদ হিন্দ সরকারের জাতীয় সঙ্গীতের জন্য সুভাষ চন্দ্র সেই রবীন্দ্রনাথেই ফিরলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'ভারত ভাগ্য বিধাতা' কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রচনা করা হল 'শুভ সুখ চৈন কী বরখা বরষে ভারত ভাগ হৈ জাগা'

গানটির স্বরলিপি তৈরি করেছিলেন অম্বিক মজুমদার এবং স্বরগ্রাম রচনা করেছিলেন ক্যাপ্টেন রাম সিং ঠাকুর। শোনা যায় গানটা পিয়ানোতে বাজিয়ে নেতাজিতকে শোনানো হয়েছিল। আজাদ হিন্দ রেডিওর অন্যতম লেখক মমতাজ হুসেন এবং আজাদ হিন্দ বাহিনীর কর্নেল আবিদ হাসান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'জন-গণ-মন' থেকেই 'শুভ সুখ চৈন' গানটি লিখেছিলেন।

দু'জনে মিলে বন্দি মুক্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গিয়েছেন, বন্যার সময় সাহায্যের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন এক সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলার জন্য লড়াই করেছেন। বন্যা দুর্গতদের সাহায্যের জন্য পাশে পেয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রকেও। আজ যে মহাজাতি সদন দাঁড়িয়ে আছে, তার নেপথ্যেও ছিলেন এই দুজন। মহাজাতি সদনের নামকরণটি করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এমন অনেক স্মৃতি রয়েছে দুজনের।

আবার বিতর্কেও জড়িয়েছেন দুজনে আমহার্স্ট স্ট্রিট সিটি কলেজে সরস্বতী পুজোকে কেন্দ্র করে দুজনের মধ্যে মতবিরোধ হয়। আবার সে মনোমালিন্য মিটেও যায়। আরও এক বিষয়ে দুজনের মতানৈক্য হয়েছিল।​

সালটা ১৯৩৭ ১৯ অক্টোবর ​'বন্দেমাতরম' গান প্রসঙ্গে নেতাজিকে চিঠি লেখেন কবিগুরুকে। তাতে 'বন্দেমাতরম' গানের প্রসঙ্গ টেনে এনে কবি লিখছেন, "বন্দেমাতরম গানের কেন্দ্রস্থলে আছে দুর্গার স্তব। একথা এতই সুস্পষ্ট যে এ-নিয়ে তর্ক চলে না। অবশ্য বঙ্কিম এই গানে বাংলাদেশের সঙ্গে দুর্গাকেও একাত্ম করে দেখিয়েছেন। কিন্তু স্বদেশের এই দশভূজা মূর্তি রূপের যে পূজা যে কোনও মুসলমান স্বীকার করে নিতে পারে না।

কিন্তু যে রাষ্ট্রসভা ভারতবর্ষের সকল ধর্ম সম্প্রদায়ের মিলন ক্ষেত্র সেখানে এ গান সর্বজনীন ভাবে সঙ্গত হতেই পারে না। ...বন্দেমাতরম প্রবন্ধটি কৃষ্ণ কৃপালিনীর লেখা। বিশ্বভারতীর কাগজে তিনি এটা প্রকাশ করবেন আমি জানতুম না। বিশ্বভারতীর সঙ্গে এই আলোচনার কোনও যোগ নেই।" এ নিয়ে জহরলাল নেহেরুকে তাঁর চিঠি লেখার কথা ছিল। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে এই চিঠি লিখলে তার জবাবও দিয়েছিলেন নেতাজি।

কিন্তু তাঁর সেই জবাবের হাতের লেখা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। চিঠিটির বিভিন্ন স্থান অস্পষ্ট থাকায় তা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ১৯২২ সালে কার্শিয়াংয়ের গিদ্দা পাহাড়ের বাড়িটি অসমের এক ডেপুটি পুলিশ সুপারের থেকে নেতাজির দাদা শরৎচন্দ্র বসু কিনেছিলেন। কার্শিয়াংয়ের বাড়িতেই ১৯৩৬-এর জুন থেকে ডিসেম্বর এক টানা ছ'মাস নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে ব্রিটিশরা গৃহবন্দি করে রাখেছিল। ঐ বাড়িতেই চিঠি রাখা রয়েছে। এমন অজস্র চিঠি বিনিময় হয়েছে দুজনের মধ্যে, যা ইতিহাসের অনন্য আকর ও পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রামান্য দলিল।

রবিন্দ্রনাথ গড়েছিলেন শান্তিনিকেতন। ২০শে নভেম্বর, ১৯৩৮ সালে শান্তিনিকেতন ভ্রমণের ইচ্ছে প্রকাশ করে এবং কবির সাক্ষাৎ প্রার্থনা করে রবীন্দ্রনাথকে চিঠি দেন সুভাষ চন্দ্র। সেই চিঠিন পেয়ে আনন্দিত হন কবি। উত্তরে লেখেন সুভাষ কখন শান্তিনিকেতনে আসবেন তিনি যেন জানান, এও লেখেন অনেক বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করার রয়েছে। কিন্তু বাইরে থাকার কারণে অনেক পরে এ চিঠি পান সুভাষ।

৮ই ডিসেম্বর ১৯৩৮ এ শ্রীনিকেতন শিল্প বিপনী কেন্দ্রের উদ্বোধনে গিয়ে নেতাজি বলেন, "প্রায় ২৪ বৎসর পূর্বে আমরা কয়েকজন ছাত্র কবিগুরুর নিকট যাই তাঁহার নিকট হইতে কিছু উপদেশ লইতে। তিনি আমাদের পল্লীসংগঠনের কথা বলেন। তখন বুঝতে পারি নাই। পরে যতই দিন যাইতে লাগিল ততই বুঝিতে পারিলাম তাহার মূল্য কতখানি।" অর্থাৎ ঐ সময়েই সুভাষের বুকে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশ চিন্তার বীজ বপন করেছিলেন।

শান্তিনিকেতনের ভবিষ্যতচিন্তায় শঙ্কিত ছিলেন কবি, তাঁর মৃত্যুর পরে শান্তিনিকেতনের কী হবে এই চিন্তা তাকে ভাবাত। তবে নেতাজি আশাবাদী ছিলেন বীরভূম জেলার গন্ডি ভেদ করে সমগ্র বিশ্বে শান্তিনিকেতন ছড়িয়ে পড়বে। বাস্তবেই তা হয়েছে আজ। ১১ই ডিসেম্বর ১৯৩৮ সালে ওয়ার্ধায় কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক শুরু হয়। ঐ বৈঠক থেকেই ১৪ই ডিসেম্বর তিনি রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে জানান জানুয়ারীর মাঝামাঝি তিনি শান্তিনিকেতন যেতে চান।  

২০শে ডিসেম্বর সেই চিঠির উত্তরের রবীন্দ্রনাথ লিখলেন তোমার আসার প্রতীক্ষা করে রইলুম। ১৯৩৯-এর জানুয়ারী ত্রিপুরী কংগ্রেসের সময়, গান্ধীজি নেতাজি চাপানউতোর উত্তাল কংগ্রেস। ১৪ই ১৯৩৯ সালে রবীন্দ্রনাথ চিঠি দিলেন, তিনি সুভাষকে দেশনায়ক রূপে বরণ করে নিতে চান। চিঠিতে লিখলেন, ফেব্রুয়ারীর শুরুতে তিনি কলকাতা যাবেন। সঙ্গীত ভবনের সাহায্যকল্পে নাটক মঞ্চস্থ হবে। ফেব্রুয়ারীর ৪ তারিখ ছিল অভিনয়ের প্রথম দিন। ঐদিন নাট্যশালায় তিনি সুভাষকে প্রকাশ্যে অভিনন্দিত করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। ১৬ জানুয়ারী কলকাতায় ফিরে সুভাষ চিঠি লিখলেন, তিনি শান্তিনিকেতন যেতে চান। তিনদিন পরে ১৯ তারিখ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে চেয়ে ফের চিঠি দিলেন।

এই সময় নানান কিছু চলছিল, দেশ উত্তাল, কংগ্রেস উত্তাল। সুভাষ বোস ঈর্ষার শিকার হচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ সবই উপলব্ধি করে সুভাষকে লিখে জানিয়েও ছিলেন। কংগ্রেসে নেতাদের মধ্যে বিবৃতি পাল্টা বিবৃতির পর্ব শুরু হয়। সেই সব ইতিহাস কিছু জানা আর অনেকটাই অজানা যে দেশ নায়কের জন্মদিনে এই বিতর্ক না হয় বাদ থাক।

কিন্তু রবি ঠাকুরের ইচ্ছের কী হল? ২৭ শে জানুয়ারী ১৯৩৯ সালে কবি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে চিঠিতে জানালেন, "কল্যায়নীয় সুভাষ সম্পূর্ণ অনিবার্য কারণে এবং শারীরিক দুর্বলতা বৃদ্ধি হওয়াতে আপাতত তোমার অভিনন্দন সভা বন্ধ রাখতে বাধ্য হতে হল। সুরেন এবং সুকান্তর কাছ থেকে সমস্ত বিবরণ শুনতে পাবে। তোমার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও স্নেহ অক্ষুন্ন আছে এ সম্বন্ধে সংশয় মাত্র করো না।" নীচে লিখেছিলেন তোমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

রবীন্দ্রনাথ অভিনন্দন পত্রটি রচনাও করে ফেলেছিলেন। শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রসদনে দেশনায়ক নামে ঐ অভিনন্দন পত্রটির নোট রয়েছে। অভিনন্দন পত্রের তিনিটি কপি পাওয়া যায়

১) বাংলায় রচিত দেশনায়ক অভিনন্দন পত্র। অন্য করোও হাতে সেটি লেখা হয়েছিল। তার উপর সংশোধন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

২) ইংরেজি ভাষায় রচিত দেশনায়ক অভিনন্দন পত্র। রবি ঠাকুরের নিজের হাতে লেখা। কিছু সংশোধন করা ছিল।

৩) দেশনায়ক অভিনন্দন পত্র, ইংরেজিতে টাইপ করা। বলাইবাহুল্য এটাই ছিল ফাইনাল কপি।
এই পত্রটি অনেক না বলা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রয়েছে।

ভাগ্যের পরিহাসে এই দুজন মানুষের কেউই স্বাধীন ভারত দেখে যাননি। ১৯৪১-এ চলে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। আর নেতাজি শেষ পরিণতি আমাদের অজানা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...