বাঙালির খাঁটি রত্ন, নীলরতন সরকার

এক স্বপ্নউড়ানের নাম নীলরতন সরকার। ভাবুন তো যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আপনি পড়লেন, সেই প্রতিষ্ঠানকে পৃথিবী আজ আপনার নামেই চেনে, এ প্রাপ্তির বোধ করি কোন তুলনাই হয় না! শুধু এক শতাব্দী পিছিয়ে যেতে হবে সেই সব গল্প শুনতে, চলুন আমরা সেখানেই একটু ঢুঁ মারি।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার নেত্রা গ্রামে ১৮৬১ সালের ১ লা অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। নীলরতনের বয়স তখন সাত, ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে  তাঁদের বাড়ি ঘর ধ্বংস হল। পাঁচ ছেলে, তিন মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে নন্দলাল আশ্রয় নিয়েছিলেন শ্বশুরবাড়ি জয়নগরে। তারপর কেটে যায় সাত বছর, গুরুতর অসুস্থ থাকোমণি দেবী টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন। চোখের সামনে মাকে মারা যেতে দেখলো ১৪ বছরের ছেলে নীলরতন। প্ৰতিজ্ঞা করলেন ডাক্তার তাকে হতেই হবে! 

অসহায় হয়ে দেখেছিলেন সাধারণ মানুষের অসহায়তা। টাকার অভাবে কত মানুষের জীবন চলে যায়। এই ঘটনা থেকে জীবনের শিক্ষা পেয়েছিলেন নীলরতন। সেই মুহূর্ত থেকেই জীবনের লক্ষ্যটা ঠিক হয়ে গিয়েছিল তাঁর। তাঁকে ডাক্তার হতেই হবে এবং সাধারণ মানুষদের পাশে এসে দাঁড়াতেই হবে। ১৮৭৬ সালে জয়নগর হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করলেন।  নীলরতন ভর্তি হলেন শিয়ালদহের ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে যা আজকের এনআরএস। শিক্ষা জীবনে অভাব ছিল তাঁর নিত্য সঙ্গী। সংসার সচল রাখতে শিক্ষকতা শুরু করলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অবিনাশচন্দ্র। নীলরতন সেই সময়ে উপার্জনের জন্য শিক্ষকতা, পরীক্ষার হলে পাহাড়া, জনগণনার ইত্যাদি কাজ করেছেন।

শিক্ষাজীবনেই তিনি প্রখ্যাত চিকিৎসক তামিজ খানের প্রিয় ছাত্র হয়ে উঠলেন। ১৮৮১ সালে এলএমপি পাশ করলেন ভাল ভাবে। কিন্তু সেই ব্রিটিশ শাসিত ভারতে মেডিক্যাল শিক্ষায় প্রচলিত ছিল বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা। দেশীয় ছাত্রদের জন্য বাংলায় পঠনপাঠন হত, যদিও মেডিক্যালের বই সব ইংরেজিতে। তার অনুবাদ কখনোই যথার্থ হতো না। বাংলা ভাষায় ডাক্তারি পাশ করা দেশীয় ডাক্তারদের জন্য নির্ধারিত ছিল অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জনের চাকরি, এই চাকরি করতে অপমানিত বোধ করলেন নীলরতন এবং প্রত্যাখ্যান করলেন চাকরি। পেশা বদলে চাতরা হাইস্কুলের প্রধানশিক্ষক হয়ে চলে গেলেন। এই সময়ে তিনি সহকর্মী হিসেবে নরেন্দ্র নাথ দত্তকে পেয়েছিলেন।

পরবর্তীকালে, মেট্রোপলিটন কলেজ থেকে ১৮৮৩ সালে এলএ এবং ১৮৮৫-তে বিএ পাশ করেন। ওই সময়ে তিনি কিছুদিন গ্রে স্ট্রিটে সরোজিনী নাইডুর বাবা অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় স্থাপিত অঘোরনাথ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে। শিক্ষকতার জগতে গেলেও নীলরতন সরকারের নামের আগে ডাক্তার কথাটার বসা বোধ করি অদৃষ্টর অভিপ্রায়। ক্যাম্পবেল স্কুলের তৎকালীন সুপার ম্যাকেঞ্জি সাহেবের সুপারিশে ১৮৮৫ সালে ভর্তি হয়ে গেলেন বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজে যা আজকের কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ। তাঁর রেজ়াল্ট এতই ভাল ছিল যে, পাঁচ বছরের ডাক্তারি কোর্সে সরাসরি তৃতীয় বর্ষে ভর্তি হলেন। তিনি 'গুড ইভ' বৃত্তিও পেলেন। ১৮৮৮তে কৃতিত্বের সঙ্গে এমবি পাশ করলেন। মেয়ো হাসপাতালে হাউস সার্জনশিপ করতে করতে এমএ এবং এমডি-র প্রস্তুতি শুরু করলেন। এরপর ১৮৮৯ সালে এমএ এবং এমডি দুুই ডিগ্রি একই সঙ্গে লাভ করেন। নীলরতন যখন এমডি হলেন, তার আগে মাত্র ছয়জন এমডি হয়েছিলেন। তাঁরা হলেন চন্দ্রকুমার দে, মহেন্দ্রলাল সরকার, জগবন্ধু বসু, আরডব্লিউ কার্টার, ভগবৎচন্দ্র রুদ্র এবং রামপ্রসাদ বাগচী। 

পঠনপাঠন চলাকালীন শিক্ষকতা করলেও তাঁর পুরোদস্তুর চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয়েছিল, এম.ডি. পাশ করার পর।  ৬১ নম্বর হ্যারিসন রোডে নিজ বসত বাড়িতেই তিনি প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেছিলেন। তার পরে পরবর্তী প্রায় পাঁচ দশক ধরে ভারতবর্ষের চিকিৎসকদের মধ্যে খ্যাতির শিখরে ছিলেন নীরতন। সত্যিই রত্ন। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে থেকে এমবি হয়ে তিনি মেয়ো নেটিভ হাসপাতালে হাউস সার্জেনের পদে যোগ দেন। তিনি দরিদ্র রোগীদের বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন এবং তাদের বিনামূল্যে ওষুধ ও খাবার দিতেন।

রোগীদের কাছে তিনি ছিলেন জীবন্ত ঈশ্বর, মানবদরদী এক অদ্ভুত চরিত্র। তিনি আয় করেছেন বিপুল পরিমানে উলটপূরাণে আবার স্বদেশি শিল্প গড়তে গিয়ে প্রায় সর্বস্বান্তও হয়েছেন। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে  বলেছেন, ''কলকাতায় ২০ টাকায় ভাড়ার ঘর পাওয়া যায়। তাতেই আমার চলে যাবে।' অনেক ক্ষেত্রে তাঁর এই স্ব-সান্তনাই তাঁর শক্তি হয়ে থেকেছে ! কখনও কোনো গরিব রোগীকে অর্থাভাবের কারণে বিনা চিকিৎসায় হয়ে তাঁর দরজা থেকে ফিরতে হয়নি। কার্যত রাস্তা থেকে তুলে এনে বহু মানুষকে নিজের ৭ নম্বর শর্ট স্ট্রিটের বাড়িতে রেখে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করেছেন। একবার নয় একাধিকবার তিনি এই কাজ করেছেন !নিজের ৭ নম্বর শর্ট স্ট্রিটের বাড়িতে নীলরতন একটা ছোট্ট ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরি করেছিলেন। জুনিয়র ডাক্তারদের সেখানে কাজ করার পরামর্শ দিতেন, বহু মূল্যবান যন্ত্রপাতি কিনেছিলেন। দেশি-বিদেশি মেডিক্যাল জার্নাল রাখতেন, যাতে ছাত্ররা পড়তে পারে। 'ইলেকট্রোকার্ডিয়োগ্রাফ' যন্ত্র ভারতে প্রথম তিনিই ওই বাড়িতে বসিয়েছিলেন। ওই সময়ে বিদেশী ডাক্তারদের প্রতাপে ভয়ে থাকতেন দেশীয় ডাক্তারেরা, তাদের দর্শনী ছিলো দু-টাকা বক খুব বেশি হলে আট টাকা ! সেখানে বিদেশীদের ছিলো ১৬টাকা ,৩২টাকা বা ৬৪ টাকা। এই বিষয়েও পথিকৃত ছিলেন নীলরতন, প্রথম দেশীয় ডাক্তার হিসেবে ১৬টাকা ভিজিট নেওয়া তিনিই শুরু করেন। নীলরতন সরকার অল্প সময়ের মধ্যেই চিকিৎসক হিসাবে বিখ্যাত হন। তার পারিশ্রমিক দুই টাকায় আরম্ভ হয়ে আস্তে আস্তে ৬৪ টাকা অবধি হয়।

১৯১৫ সালে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। নবজাতক-মৃত্যু কমাতে তিনিই প্রথম 'দাই'দের প্রশিক্ষণ দিতে উদ্যোগী হন এবং তিনি সফল হন কারণ সদ্যোজাতদের মৃত্যু হার হ্রাস পায়। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি তাঁকে দিয়েছিল 'ডক্টরেট অব সিভিল ল' ডিগ্রি, আর এডিনবরা ইউনিভার্সিটি থেকে পেয়েছিলেন 'ডক্টরেট অব লেজিসলেটিভ ল' ডিগ্রি।  ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ সরকারের থেকে 'স্যর' উপাধি (নাইটহুড) পান। ১৮৯৩ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো এবং এরপর ফ্যাকাল্টি অফ সায়েন্স ও ফ্যাকাল্টি অফ মেডিসিনের ডিন হন। তিনি স্নাতকোত্তর কলা বিভাগের  ১৯২৪ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত ও বিজ্ঞান শিক্ষা বিভাগের ১৯২৪ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত সভাপতিও হয়েছিলেন।

নীলরতন ১৯০৮ সালে বুট অ্যান্ড ইকুইপমেন্ট এর নির্দেশক হয়েছিলেন। বসু বিজ্ঞান মন্দির, বিশ্বভারতী এবং ভারতীয় যাদুঘরের ট্রাস্টি ছিলেন। ১৯১২ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ছিলেন। তিনি সায়েন্স কলেজ অফ দ্য ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি এবং ন্যাশন্যাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনের বা জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে ছিলেন। তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স এর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সম্পাদক হিসাবে তিনি এদেশে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষনের চেষ্টা করেছিলেন। বেঙ্গল টেকনিক্যাল স্কুল, যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রভৃতি স্থাপনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯১৯ সাল থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। ১৯২০ সালে তিনি লন্ডনে সম্মেলনে যোগদান করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডিসিএল এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাকে এলএলডি উপাধি প্রধান করেছিল। 

এক ধন্বন্তরির নাম, নীলরতন : 

 

ডাক্তার হিসেবে তাঁর অভাবনীয় মেধার পরিচয় মেলে ,এমন দুটো ঘটনা উল্ল্যেখ করছি –অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশনের জন্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্স অফ ওয়েলস সার্জিক্যাল ব্লকে ভর্তি হয়েছেন নামী হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডিপি বসু। কিন্তু কোনও অ্যানাস্থেটিস্ট তাঁকে অজ্ঞান করতে চাইছেন না। কারণ তাঁর সাইনাস অ্যারিদমিদিয়া রয়েছে। ওই সময়  হৃদযন্ত্র পরীক্ষার আধুনিক কোনও যন্ত্রপাতি ছিল না।ওই চিকিৎসকের 'ক্লিনিক্যাল আই' অর্থাৎ ডাক্তারের অভিজ্ঞ চোখ টুকুই যা ভরসা । কেউই ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। রোগী আর তাঁর পরিজনদে বিভ্রান্তিকর অবস্থা ! প্রখ্যাত চিকিৎসক ইউপি বসু ছিলেন ডিপি বসুর বাবা । পরিশেষে তিনিই শরণাপন্ন হলেন বন্ধুবর চিকিৎসকের, যাঁকে লোকে 'ধন্বন্তরী' বলেন।অর্থাৎ এন.আর.এস ! তিনি এসেই ডিপি বসুকে প্রশ্ন করলেন, খেলাধুলো করেন ? ফুটবল খেলেন শুুনে পরপর আবার কয়েকটি প্রশ্ন। কোন পজ়িশনে খেলেন? ক্লান্ত লাগে? হাফটাইমের পরেও খেলেন? 

ফরোয়ার্ডে খেলেন, ক্লান্ত হন না এবং হাফটাইমের পরেও খেলেন শুনে, সেই ডাক্তারবাবু নির্দ্বিধায় রায় দিলেন, ''হার্টের অর্গ্যানিক কোনও রোগ নেই। স্বচ্ছন্দে অপারেশন করা যায়।'' অস্ত্রোপচার সফল হয়েছিলো । স্মৃতিচারণায় ওই ঘটনার কথা লিখেছিলেন স্বয়ং ডিপি বসু। 'ধন্বন্তরী' চিকিৎসক স্যর নীলরতন সরকারকে বলা হত 'ক্লিনিক্যাল মেডিসিনের জাদুকর'। 

এবার দ্বিতীয় ঘটনা, ভারতীয় সাংবাদিকতার জনক তথা 'প্রবাসী' পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন  তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু । নীলরতন তাঁর মেয়ে অরুন্ধতীর সঙ্গে রামানন্দের ছেলে কেদারনাথের বিয়ে দিয়েছিলেন। রামানন্দের মেয়ে সীতা দেবীর স্মৃতিচারনায় রয়েছে অসামান্য চিকিৎসক এবং অসাধারণ  এক ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা —'১৯০৮ খ্রীষ্টাব্দে যখন বরাবরের মতো কলকাতায় চলে এলাম আমরা, তখনই তাঁকে ভালো করে চিনলাম।তিনি চিককিৎসা করলে অসুখ না সেরেই পারে না, এই ছিল আমাদের বাল্যকালের বিশ্বাস।' কৈশোরে একবার দার্জিলিংয়ে গিয়ে  ভয়ঙ্কর জ্বরে পড়লেন। ডাক্তারবাবু শুধু সাবু আর বার্লি খেতে বলেন। তখন পারিবারিক পরিচিতির সূত্রে তাঁকে দেখতে এসেছেন নীলরতনের বড় বৌদি আর  তিনি এসেই ডেকে আনলেন দেওরকে। রোগিণীর ভালমন্দ খাবারের আবদার শুনে সেই চিকিৎসক সকলকে অবাক করে নিজেই কাঁচা-মিঠে আম পাঠিয়ে দিলেন! সীতা লিখেছেন, 'মাকে বলে দিলেন খুব বেশি চিনি দিয়ে অম্বল অর্থাৎ চাটনি রেঁধে দিতে। আশ্চর্য, এই পথ্য পরিবর্তনে আমার জ্বর ছেড়ে গেল। আর এল না।' 

 

মেয়ের পর এবার বাবার এককাণ্ডে কথা বলি আপনাদের, একবার রামানন্দের বড় ফোঁড়া হয়েছে। কাজে খুব ব্যস্ততা থাকায় তাঁকে দেখতে আসতে পারেননি নীলরতন এবং চিকিৎসকেরা অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিলেন। ওটিতে রোগীকে সংজ্ঞাহীন করার প্রস্তুতি চলছে, তখন উপস্থিত হলেন নীলরতন। পরীক্ষা করে রামানন্দকে টেবিল থেকে নামাতে বলে পরামর্শ দিলেন ওষুধে সেরে যাবে এবং বাস্তবে হলোও তাই।

 

স্বদেশি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা:

 

নীলরতন চেয়েছিলেন বাংলায় স্বদেশি মেডিক্যাল কলেজ স্থাপিত হোক, যেখানে দেশীয় চিকিৎসকেরাই সবরকম দায়িত্ব নেবেন। ১৮৯৫ সালে ১৬৫ নম্বর বৌবাজার স্ট্রিটে ভাড়াবাড়িতে 'কলেজ অব ফিজ়িশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস অব বেঙ্গল' প্রতিষ্ঠা করেন নীলরতন, সুরেশ সর্বাধিকারীসহ কয়েক জন। এটিই ছিল ভারতের প্রথম বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ। এর কয়েক বছরের মধ্যেই  তার ঠিকানা হল ২৯৪ আপার সার্কুলার রোডে। ১৯০৪ সালে ক্যালকাটা মেডিক্যাল স্কুল ও কলেজ অব ফিজইশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস অব বেঙ্গল মিলে গেল ও স্থানান্তরিত হল বেলগাছিয়াতে। ১৯১৬সালের ৫ই জুলাই সেখানেই তৈরি হল কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ। বর্তমানে যা আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ নামে পরিচিত হবে। যদিও ইতিহাসবিদের মতে এবং জনশ্রুতি অনুযায়ী, ১৯১৯ সালে এই কলেজের নাম হয়েছিল কারমাইকেল। তার আগে ১৯১৬-১৯ পর্যন্ত এর নাম ছিল বেলগাছিয়া মেডিক্যাল কলেজ। যদিও একটি নেপথ্য গল্প আছে, তৎকালীন ছোটলাট লর্ড কারমাইকেলের সঙ্গে দেখা করে নীলরতন জানালেন, বাঙালি ছাত্রদের জন্য তিনি একটি স্বদেশি মেডিক্যাল কলেজ বানাতে চান। সেই কারণে সরকারের অনুমোদন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি প্রয়োজন ।উত্তরে  সাহেব বললেন, ''আপনি চাইলে না বলি কী করে। তবে রাজকোষের অবস্থা ভাল নয়। এক মাসের মধ্যে আপনি এক লাখ টাকা জোগাড় করলে কলেজ হবে। অনুমোদন দেব।'' তখনকার এক লাখ টাকা, অঙ্কটা পাহাড় প্রমান ! কিন্তু অসম্ভব কে সম্ভব করেই  তো কালোত্তীর্ণ হয়েউঠলেন নীল রতন। শহরের তাবড় ধনী তাঁর রোগী, তাঁর পসার অত্যন্ত ভালো ছিলো। সবাই তাঁকে সানন্দে সাহায্য করলেন। বন্ধু রবীন্দ্রনাথ অভিজাত মহলে নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে অনেক টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। নীলরতন বাকিটা, বন্ধুদের থেকে ঋণ নিয়েছিলেন ।প্রদত্ত সময়সীমার শেষ হওয়ার আগেই ওই দিন বিকেলে টাকার থলি হাতে বাঙালি ডাক্তারকে ঢুকতে দেখে সাহেব চমকে উঠলেন । নিজেকে সামলে প্রস্তাবিত কলেজের নাম জানতে চাইলেন ; নীলরতন হেসে উত্তর দিলেন, 'কেন? আপনার নামে! কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ।' কারণ তিনি নিশ্চিতভাবেই জানতেন, স্বদেশি নাম হলেই প্রতি পদে বাধার সম্মুখীন হতে হবে অন্য দিকে, বড়লাটের নামে হলে সবরকম  সরকারি  অনুমোদন মিলবে বিনা সময়ের অপচয়ে এবং বাস্তবেও সেটাই হল।

তাঁরই চেষ্টায় তাঁর এক ধনী রোগী তারকনাথ পালিতের সার্কুলার রোডের জমিতে ১৯০৬ সালে জন্ম নিল বেঙ্গল টেকনোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট। পরবর্তী কালে এটি যাদবপুরে স্থানান্তরিত হয় ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের রূপে আত্মপ্রকাশ করে । কলকাতায় যক্ষ্মা হাসপাতালেরর জন্য ১৯২৩ সালে ক্যালকাটা মেডিক্যাল এইড সোসাইটি তৈরি হয়।যার সভাপতি ছিলেন নীলরতন এবং সম্পাদক ছিলেন ডাক্তার কুমুদশঙ্কর রায়। তাঁদের আগ্রহে ১৯২৮ সালে গড়ে ওঠে কলকাতার প্রথম যক্ষ্মা হাসপাতাল। 

তাঁর মেয়ে নলিনী দেবীর লেখা থেকে জানা যায়, ভোর তিনটে-চারটের  সময়েও তিনি দেখতেন, তার বাবার ঘরে আলো জ্বলছে এবং তার বাবা পড়ছেন। তাঁর বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত অসংখ্য বই আর দাগ দেওয়ার জন্য লাল-নীল পেনসিল।তিনি আদ্যপ্রান্ত একজন গ্রন্থকীট ছিলেন এবং  নিজের জন্য তাঁর  খরচ বলতে ছিল কেবল বই কেনা। সারা সকাল রোগী দেখে বেলা দুটোর সময়ে ফিরেতেন ।তারপর খুব সামান্য খেতেন প্রচন্ড স্বল্পাহারী ছিলেন। ১০ মিনিট বিশ্রাম নিয়েই আবার বেরিয়ে পড়তেন রোগী দেখতে।

কিন্তু এই কর্মবীরের জীবনও একদিন থামল। ১৯৩৯ সালের অগস্টে স্ত্রী নির্মলা দেবীর মৃত্যুর পরে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন নীলরতন। পরের বছরই তাঁর স্ট্রোক হয় এবং সেই  সঙ্গে শুরু হয় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। বিছানায় শুয়ে চিকিৎসকদের নিজের চিকিৎসার পরামর্শ দিতেন!

কিছুটা সুস্থ হলে তাঁর ইচ্ছেতেই বিধানচন্দ্র রায় তাঁকে করে পুরী নিয়ে যান এবং সেখান থেকে কলকাতার ফিরে কিছু দিন ভালও ছিলেন। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় কলকাতা, মূলত উত্তর কলকাতায় জাপানিদের বোমার আতঙ্কের জন্য তাঁকে গিরিডিতে তাঁর 'মাজলা কুঠী' নামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই পুনরায় তাঁর রক্তচাপের সমস্যা বেড়ে যায় এবং অবশেষে ১৯৪৩ সালের ১৮ মে শুক্লা চতুর্দশীর দুপুরে তাঁর মৃত্যু হয়। উশ্রী নদীতীরে তাঁর দেহে বিলীন হয় পঞ্চভূতে। পার্থিব জগৎ ছেড়ে চলেগেলেন নীলরতন, পড়ে রইল বাঙালির গর্ব করার মতো একটা অধ্যায়; স্বর্ণাক্ষরে লেখা সেই ইতিহাস। বাঙালির জয়গাঁথা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...