ইতিহাসের আড়ালে থেকে যাওয়া এক রানী
রাজত্ব, সাম্রাজ্য বিস্তার ও বানিজ্য। প্রতিটি ঘর সাজিয়েছিলেন সুনিপুণ দক্ষতায়।
জনৈক পণ্ডিতদেরই তথ্য মনে রাখতে গেলে হিমশিম খেতে হয় কখনও। সেখানে ইতিহাস এবং ঐতিহাসিকদের আর কী দোষ!
অনেক তথ্যের ভিড়ে অনেক কিংবদন্তীই চাপা পড়ে যায়। সময়ের ফেরে তারা আবার ফিরেও আসে। সত্য উদঘাটিত হয়। সে আবার নিজের প্রাপ্য জায়গা খুঁজে নেয় ইতিহাসের পাতায়।
এমনই এক ব্যক্তিত্ব ফিরে এলেন এভাবেই। দক্ষিণের মশলা রানী।
ওরফে রানী চেন্নাভইরাদেবী। একটানা চুয়ান্ন বছর সাম্রাজ্যের রাশ টেনেছেন বেহাল তবিয়তে। ভারতের ইতিহাসে এত বছর ধরে সাম্রাজ্য শাসন করা তিনিই একমাত্র মহিলা।
টাইম মেশিনে চেপে এক্টু দেখে নেওয়া যাক পুরনো অ্যালবাম।
১৪৯৮ সালে ভারতের দক্ষিণের মালাবার উপকূলের কালিকটে পৌঁছেছিলেন পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দ্য গামা। তিনিই প্রথম ইউরোপ থেকে জলপথে ভারতে আসার রাস্তা আবিষ্কার করেছিলেন।
তারও কয়েক বছর পরে ১৫০৩ সালে ভারতের কোচিতে প্রথম দুর্গ স্থাপন করেন পর্তুগিজরা।শুরু হয় ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য। ইউরোপ এবং ভারতের মধ্যে ব্যবসার খাতিরে যাতায়াত শুরু হয় পর্তুগিজদের। পর্তুগিজদের দখলে প্রায় চলেই গিয়েছিল গোয়া, সে সময়ই তাঁদের আগ্রাসন থেকে গোয়াকে রক্ষা করেছিলেন এই রানি।
ভারতের ইতিহাসে ঝাঁসির রানি, গায়েত্রী দেবী, রাজিয়া সুলতানাদের নাম সবাই পড়েছে। কিন্তু খুব কম মানুষই এই রানির কথা জানেন।
১৫৫২ সালে ভারতের দক্ষিণে মাথা তুলে দাঁড়ায় সালুভা সাম্রাজ্য। গোয়া থেকে, উত্তর কন্নড়, দক্ষিণ কন্নড়, মালাবার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই সাম্রাজ্য। রাজধানী ছিল গেরুসোপ্পা।মাথার উপর ছিলেন চেন্নাভইরাদেবী।
তাঁর রাজত্বকাল ছিল প্রজাদের কাছে স্বপ্ন। তাঁর উদারতার ছোঁয়া সকল প্রজাদের কাছেই পৌঁছত সমান ভাবে। পাশাপাশি তাঁর রাজত্বকালে সালুভায় ব্যবসার প্রসারও ঘটেছিল বিস্তর।
সে সময় পর্তুগিজদের অনেকেই ওই অঞ্চলে ব্যবসা করতে এবং বন্দরগুলোর দখল নিতে চেয়েছিল। পর্তুগিজদের সেই আগ্রাসনকে তিনি একার হাতে প্রতিহত করেছিলেন।
পার্শ্ববর্তী কেলাড়ি এবং বিলগি রাজাদের কুনজর থেকেও বহুদিন সুরক্ষার চাদরে আগলে রেখেছিলেন নিজের রাজ্যকে।
তাঁর নামাঙ্কিত তামার মুদ্রার প্রচলন ছিল সে সময়। তাঁর রাজত্বকালে সালুভা সাম্রাজ্য ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। দেশের নানা প্রান্ত থেকে মানুষ ব্যবসা এবং পর্যটনের সূত্রে এখানে আসতেন।
তাঁর সাম্রাজ্যের হন্নাবর, ভাতকালা অঞ্চলগুলো দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বাজারে পরিণত হয়েছিল। ইউরোপ থেকে ব্যবসার উদ্দেশে এই অঞ্চলগুলোতে বাণিজ্য শুরু হয়।
রানি চেন্নাভইরাদেবীর রাজত্বকালে এই অঞ্চলগুলোতে কালো মরিচ, সুপারি, জায়ফল এই মশলাগুলোর ব্যবসা প্রসার লাভ করে। সে কারণেই পর্তুগিজরা তাঁকে পেপার কুইন বা মশলা রানি ও বলতেন।
তিনি জৈন ধর্মাবলম্বী ছিলেন। ১৫৬২ সালে কারকালায় শিখ মন্দির চতুর্মুখ বসারি নির্মাণ করেন। অন্যান্য বহু মন্দিরও নির্মাণ করেছিলেন।
৬৬ নম্বর জাতীয় সড়ক থেকে মাত্র পাঁচশো মিটার দূরে কর্নাটকের উত্তর কন্নড় জেলায় তিনি মিরজান দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন।
সেই দুর্গ আজও পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্র। এই দুর্গে তিনি জীবনের অনেকটা সময়ও কাটিয়েছিলেন।
তাঁর পার্শ্ববর্তী কেলাড়ি এবং বিলগি রাজারা বহুদিন থেকেই চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন এই গেরুসোপ্পার দখল নেওয়ার।
অবশেষে দুই রাজা মিলিত ভাবে ১৬০৬ সালে রানি চেন্নাভইরাদেবীকে পরাজিত করেন।
গেরুসোপ্পা কেলাড়ি রাজত্বের অংশ হয়ে ওঠে। রানিকে বন্দি করে রাখা হয়। বন্দি অবস্থাতেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।