মহাত্মা গান্ধী তখন কলকাতা বেতার কেন্দ্রে এসেছেন। স্টুডিয়োতে গান বাজছে। 'তোমায় গুণী যেন শুনি'। সুরকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র শ্রী দিলীপ কুমার রায়। গায়িকার গলা অত্যন্ত সুরেলা। পাপিয়া পাখির মত মিষ্টি।
মহাত্মা গান্ধীর সখ্যতা ছিল সুর, গান এসবের সঙ্গে। তিনি সেদিন স্টুডিয়োতে ওই গানটি শুনে জানতে চাইলেন গায়িকার কথা। তখন মাত্র পনেরো বছর বয়স গায়িকার।
বয়সে নিতান্তই কিশোরী হলেও, গানের গলায় ছিল সাক্ষাৎ সরস্বতীর বাস। মুগ্ধ হয়েছিলেন গান্ধীজী।
গায়িকার নাম জানতে পারলেন। উমা বসু। তাঁর গানে যেন সুরেলা পাখিরা ডানা মেলে। তাঁর গান শুনলে রামধনুর রঙের আবেশ ছড়িয়ে যায়। মহাত্মা গান্ধী তাঁকে নাম দিলেন 'বাংলার নাইটিঙ্গেল' ।
ধরণী বসু এবং প্রভা বসুর কন্যা উমা বসু। ১৯২১ সালের ২২শে জানুয়ারি কলকাতায় জন্ম। বাবা ছিলেন কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের মেয়র।
শিক্ষিত, অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন উমা।
ছোট থেকেই গানের প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল উমা বসুর। সঙ্গে ছিল ভগবান প্রদত্ত কণ্ঠ।
সঙ্গীতজ্ঞ দিলীপ কুমার রায়ের কাছ থেকে প্রথম সঙ্গীতের তালিম নেন তিনি। দুজনে একসঙ্গে অনেক আধুনিক গানের সুর দিয়েছেন। উমা বসু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখেছিলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে।
সেতার বাজাতে ভালোবাসতেন।
আকাশবাণী কলকাতার সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন তিনি। কলকাতা বেতার কেন্দ্রের নিজস্ব রেকর্ডিং অর্থাৎ রম্যগীতিতে উমা বসুর গাওয়া গানে আজও ভেসে বেড়ায় অবগাহনের সুর।
সেই সময় হিমাংশু দত্তের সুর করা গানে আবিষ্ট থাকত বাঙালি। উমা বসুও তাঁর সুর করা গান গেয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে একটা বিশেষ গানের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৩৮ সাল। ''চাঁদ কহে চামেলি গো''। হিমাংশু দত্তের সুর। মূল গানের বিষয় ছিল চাঁদের সঙ্গে চামেলি ফুলের সম্পর্ক। তাই সুরকার চাইছিলেন গানের শুরুতে এমন কিছু থাকুক যা চাঁদের আলোর মতোই শ্রোতার কানে ছড়িয়ে পড়বে। সেটা শুধু গানের কথা দিয়ে সম্ভব ছিল না। গানের কথা, সুর, যন্ত্রের ব্যবহার সবকিছু মিলিয়ে আলোর ছটা তৈরি করতে চাইছিলেন সুরকার।
তিনি উমা বসুকে বেছে নিলেন এই গানের গায়িকা হিসেবে। সুর আছে, কথা আছে, যন্ত্র আছে, গায়িকাও রাজি। এখন শুধু আলো সৃষ্টির পালা।
সুরকারের বারবার মনে হচ্ছিল শুরুর দিকে যদি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মূর্ছনা থাকে, তাহলে হয়ত সেই আলো খুঁজে পাওয়া যাবে।
গায়িকা নিজেই সেই আলো ছড়িয়ে দিলেন। "চাঁদ কহে চামেলি গো" এই গানের শুরুর প্রথম এক মিনিট কুড়ি সেকেন্ড নিজের শাস্ত্রীয় সংগীতের শিক্ষা আর আধুনিক গানের শিক্ষার মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন গায়িকা। গিটার, সেতার আর তবলার মিশ্রণে সুরের রামধনু আঁকা হয়েছিল। তারপর শুরু হয়েছিল মূল গান। সেই গান আজও আলো ছড়ায়।
হিমাংশু দত্ত এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন, ১৯৪০ সালে আবার একটি গানের সুর করেছিলেন যার কথা ছিল চাঁদকে ঘিরে। ''আকাশের চাঁদ''। গায়িকা সেই উমা বসু। এই গানটির শুরুর সুর ছিল তিনটি রাগের মিশ্রণ। গৌড়মল্লার,কেদার এবং কামোদ। উমা বসু আবারও হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং আধুনিক গানের মিশেল ঘটিয়েছিলেন।
হিমাংশু দত্ত এবং দিলীপ কুমার রায়ের সঙ্গে যুগলবন্দীতে উমা বসু প্রায় ষোলটি গান গেয়েছিলেন এবং তাতে সুর দিয়েছিলেন।
মাথার দু'দিকে লম্বা বেণী। গভীর চোখ। যখন সেতার বাজাতেন তাতে বুঁদ হয়ে থাকতেন। গান গাওয়ার সময় অন্য জগতে বিচরণ করতেন।শ্রোতার কান, মন সবকিছুতেই রং ছড়িয়ে দিতেন।
এই গায়িকা ছিলেন ক্ষণজন্মা। পনেরো বছর বয়সে প্রথম বেতার কেন্দ্রে গান গেয়েছিলেন। তারপরে আর মাত্র ছ’বছর সুযোগ পেয়েছিলেন গান গাওয়ার। ১৯৪২ সালে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। দিনটা ছিল তাঁর একুশ বছরের জন্মদিন।
অল্প সময়ের এই জীবনকালে নিজের গান, সুর, বাজনা এসব দিয়ে যতটুকু পেরেছেন পৃথিবীর বুকে আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন।