কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত তাঁর সম্পর্কে লিখলেছিলেন, ‘কুয়াশার ঘন অভিমানে
ডুবে আছে, অকূল ক্রন্দন
আচ্ছন্ন করেছে চরাচর
তবুও ঋজুতা দিল প্রাণে
সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠস্বর।’
তিনি আর রবীন্দ্রসঙ্গীত যেন সমার্থক। ট্রেন ছুটে চলেছে, ১৯২৪ সাল, দিনটা ছিল ১৯ শে সেপ্টেম্বর। ট্রেনেই জন্ম হল তাঁর। সেই সময় ট্রেনটি পৌঁছেছিল বিহারের গুজন্ডি স্টেশনের কাছে ছিল। আর সেই থেকেই তাঁর ডাকনাম হয়ে গেল ‘গজু’। তিনি আর কেউ নন, কিংবদন্তী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সুচিত্রা মিত্র। তাঁর বাবা সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় ছিলেন সে সময়ের বিশিষ্ট সাহিত্যিক। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল তাঁর। হয়ত সেই সূত্রেই ছোট্ট থেকে রবীন্দ্রিক ছোঁয়া পেয়েছিলেন সুচিত্রা! ছোট থেকেই তাঁর সঙ্গীত সাধনার শুরু, পঙ্কজ কুমার মল্লিকের কাছেও তিনি গান শিখেছিলেন ছোটবেলায়।
ততদিনে রবীন্দ্রনাথ মারা গিয়েছেন, শান্তিনিকেতনের আশ্রমে ছাত্রী হয়ে এলেন সুচিত্রা। ছিপছিপে চেহারা সপ্রতিভ, চঞ্চল। কিন্তু তাঁর মেধা প্রাজ্ঞতে মুগ্ধ ছিল সকলেই। তরুণ সুচিত্রা মিত্রের আবৃত্তি আর অভিনয়ে মুগ্ধ ছিল সে সময়ের আশ্রমের প্রায় সকলেই, সেই সঙ্গে গান তো ছিলই। বাল্মীকি প্রতিভায় সরস্বতীর ভূমিকায় অভিনয়ও করেছিলেন তিনি।
তবে কেবল এ সবের জন্য নয়, সুচিত্রা মিত্র সকলের থেকে আলাদা ছিলেন তাঁর দৃঢ় ব্যক্তিত্বের জন্যে। তাঁর অনমনীয় শিরদাঁড়া তাঁকে এক অন্য সুচিত্রা করে তুলেছিল বারবার।
১৯৪৬-এর আগস্ট, ভারত স্বাধীন হওয়ার এক বছর আগের ঘটনা। কলকাতার রাজপথ তখন ভাই-ভাইয়ের বিবাদে রক্তিম। রক্তাক্ত ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গায় কলুষিত হল কলকাতা। পরাধীন ভারতের অন্যতম বড় প্রাণঘাতি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।
তখন দাঙ্গার বিরুদ্ধে পথে নামলেন লেখক ও শিল্পীরা, শুরু হল তাঁদের অভিযান। মিছিল নিয়ে কলকাতার জায়গায় জায়গায় সম্প্রীতির বার্তা দিচ্ছিলেন শিল্পীরা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে যখন সে মিছিল পৌছাচ্ছিল, নিমেষের মধ্যে মিছিলের গাড়িগুলিকে ঘিরে ফেলছিল হাজার হাজার দাঙ্গাপীড়িত মানুষ। তাঁদের জন্যে, তাঁদের ঐ শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে ট্রাকের উপরে দাঁড়িয়ে সুচিত্রা মিত্র গান ধরলেন,‘সার্থক জনম আমার...।’ বিভাজনের ওই বদ্ধভূমিতে জ্বেলে দিলেন ভালোবাসার আগুন।
দাঙ্গাবিধ্বস্ত মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারতেন সুচিত্রা। কেবল গান গেয়ে থামিয়ে দিতে পারতেন দাঙ্গা। নিকারাগুয়ার মুক্তিসংগ্রামের জন্যে আবার অসুস্থ শরীর নিয়ে গান গেয়ে টাকাও তুলে দিয়েছেন সেই তিনিই। গণনাট্য সংঘের হয়ে একাধিকবার রাস্তায় নেমে মিছিল করেছেন তিনি। শিল্পী কিংবদন্তী ইমেজ ভেঙে আশপাশের সাধারণ মানুষদের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন বারবার। আন্দোলন থেকে দূরে নয়, বরং ঝাঁপিয়ে পড়েছেন লড়াইয়ের ময়দানে।
১৯৬০ সালের কথা, দিল্লির আকাশবাণীর লাইভ প্রোগ্রামে বাল্মীকি প্রতিভার জন্য গান গাইছিলেন সুচিত্রা। সেই সময়েই সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে, তখন সেখানেই চলছিল কালো পতাকা প্রদর্শন। অন্যদিকে সুচিত্রা গাইছিলেন, "কাজের বেলায় উনি কোথা যে ভাগেন, ভাগের বেলায় আসেন আগে"।
তারপর হঠাৎই রটে গেল সুচিত্রা নেহেরু বিরোধী। রিপোর্ট এল, তাতে বলা হল সুচিত্রা মিত্র 'অ্যান্টি-নেহরু'! এরপরে ছ বছরের জন্য আকাশবাণীতে সুচিত্রা মিত্রের গান গাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাতে অবশ্য তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। সুচিত্র মিত্রের নিজের কথাতে, "আমি বললাম, আমার বয়েই গেল।"
একদা এক নামী রেকর্ডিং কোম্পানীতে ঘটেছিল এক মারাত্মক ঘটনা! রেকর্ডিং করতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তাঁকে এক আধিকারিক এমন কিছু বলেন, যা সুচিত্রা মিত্রের পক্ষে খুব অবমাননাকর হয়ে দাঁড়ায়। রেকর্ডিং ছেড়ে তিনি সোজা বেরিয়ে আসেন। আসার আগে সেই আধিকারিককে বলে এসেছিলেন, ‘‘মনে রাখবেন, সুচিত্রা মিত্র বাজারের আলু-পটল নয়! এখানে আর কখনও পা দেব না।’’ খবর পেয়ে সংস্থার মালিক পক্ষ তড়িঘড়ি ছুটেছিলেন তাঁর বাড়িতে। ভুল স্বীকার করে, ক্ষমা চেয়ে হাতে পায়ে ধরে তাঁকে ফিরিয়ে আনতে রীতিমতো কালঘাম ছুটে গিয়েছিল রেকর্ডিং কোম্পানীর কর্তাব্যক্তিদের। দেশে তখন জরুরী অবস্থা চলছে, সে সময়ের কথা। রবিতীর্থের ৩৩ জনকে নিয়ে আমেরিকায় অনুষ্ঠান করতে যাবেন তিনি, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় তাঁকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সফর হিসেবে
রাজ্য সরকার তাঁদের যাতায়াতের খরচ বহন করবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে কথা রাখেনি সরকার। এত ছেলেমেয়ের যাওয়ার বন্দোবস্তও সম্পূর্ণ, কিন্তু সব কিছুই যে ঠিক। শেষ মুহূর্তে টাকার জোগাড় হবে কী করে! এ কথা জানতে পেরে এগিয়ে এলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, নিজের মুম্বইয়ের বাড়ি বন্ধক রেখে আপাতত তিনি টাকা জোগাড় করে দেবেন; বলে প্রস্তাব দিলেন।
কিন্তু সুচিত্রা মিত্র তাঁকে বললেন, ‘হেমন্ত, তোমার এই সহায়তার কথা মনে থাকবে। কিন্তু আমি নিজে চেষ্টা করব। তাতে যা হয় হবে। তবে নির্দিষ্ট দিনেই আমরা আমেরিকায় যাব।’ নিজের সব গয়না নিয়ে ব্যাঙ্কে রওনা দিলেন সুচিত্রা। টাকা পেয়ে গেলেন। বিদেশ সফরে রওনা হওয়ার আগের দিন জয়ীর মতো সবার টিকিট হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন তিনি। ছাত্রছাত্রীদের বললেন, ‘দ্যাখ তোরা। টিকিট রেডি! কাল সকালে সোজা এয়ারপোর্ট!’
বিষয়টি কিন্তু এখানেই শেষ হয়নি। নিজের জোরে ৩৩ জনকে নিয়ে পাড়ি দিলেন মার্কিনমুলুকে। ফিরে আসার কিছু দিন পরেই হঠাৎ ভারত সরকারের সিলমোহরে বন্দি একটি খাম এসে পৌঁছাল সুচিত্রা মিত্রের ঠিকানায়। ভিতরে একটি চেক। যাতায়াতের খরচ বাবদ পুরো টাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ছাত্রছাত্রীদের ডেকে তিনি বলেছিলেন, 'মনের জোর হারাতে নেই। বাধা কেটে যাবেই।' এমনই ছিলেন তিনি।
কিন্তু নিজের একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে কেমন ছিলেন তিনি, জীবন কাটিয়েছেন একাকীত্বে, তাঁর বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল। নিজের ছেলেকে একাই বড় করেছেন তিনি। একা লড়ার লড়াইয়ে তিনি সত্যিই বিজয়িনী। তাঁর মন্ত্রই বোধহয় একলা চলো রে। বার্ধক্যে ছেলের কাছে আমেরিকা গিয়েও থাকেনি। ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবনে, তাঁর এই দৃঢ় ব্যাক্তিত্বই তাঁকে সুচিত্রা মিত্র বানিয়ে দিয়েছে।
তাই তো তিনি নিজেই বলে গিয়েছেন, ‘অপরকে আনন্দ দেবার জন্য গান আমি গাই না। আমি নিজে আনন্দ পেলে নিশ্চিত জানি অপরকে তা আনন্দ দেবে। রবীন্দ্রনাথের দুঃখের গান আমাকে অভিভূত ও আকর্ষণ করে বেশি কারণ সে দুঃখ তো দুঃখ নয় এক আশ্চর্য উত্তরণ।রবীন্দ্রনাথের দুঃখের গান আমাকে জীবন চিনতে শেখায়, মনকে সুদৃঢ় করে তোলে। এ এক আশ্চর্য শিক্ষা।’