কলকাতা, আমাদের আবেগের 'মেট্রো' শহর। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের ব্যস্ততার আওয়াজে মরে গিয়েও বার বার বেঁচে ওঠে রাজপথ। বাসের বেপরোয়া হর্ণ, অটোর হাঁকডাক, মেট্রোয় অপঘাত সব কিছু পেরিয়ে কত হাজার ধরনের মানুষ হাজার রকম কাজে ছুটে চলেন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত।
এমন নিদারুণ টিকে থাকা, জীবন যাপনের স্বার্থে আপনি যখন প্রায় ঘেঁটে যাওয়ার দশায়, ধরুন ঠিক সেই সময় আপনার কানের ভিতর দিয়ে, স্নায়ুর ভিতর দিয়ে, একেবারে মনের মধ্যে যদি ঢুকে পড়ে কোনও শান্ত-গভীর সুর, যা ঝুপ করে নামিয়ে দিতে পারে আপনার যাবতীয় ক্লান্তি...সেটুকুই কি যথেষ্ট নয় এসময়ে?
না, মোবাইলে হেডফোন গুঁজে নিয়ে পছন্দের মিউজিক লিস্ট প্লে করার কথা আমি একেবারেই বলিনি। সেই শান্ত-গভীর সুরের কাছে পৌঁছাতে কোনও 'স্পা' বা 'মিউজিক থেরাপিস্ট'-এর কাছেও দৌঁড়াতে হবে না আপনাকে, শুধু চিনে নিতে হবে 'হ্যামিলন' নয়, খোদ শহর-কলকাতার বুড়ো-ফকির এক বাঁশিওয়ালাকে।
“নাম কী? বলছি, তোমার নাম টা কী?...” সামনে দাঁড়িয়ে তিন-চার বার নাগাড়ে এই প্রশ্নটাই করার পর, ভাবলাম নিশ্চয়ই খুব মন দিয়ে বাঁশিতে সুর দিচ্ছেন, বাঁশি থামলে ফের জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু না, তাতেও সাড়া দিলেন না তিনি। এবার একেবারে পাশে ঘেঁষে বসে জিজ্ঞেস করলাম, নাম কী? সঙ্গে সঙ্গে হাসি মুখ নিয়ে... নাম মনোরঞ্জন হালদার ওরফে 'মনে মনে' (ভালবেসে লোকে এ নামেই ডাকে তাকে, শিশুসুলভ হেসে জানিয়ে দিলেন তিনি)। বুঝলাম এতক্ষণ 'অ্যাটেনশন' না পাওয়ার কারণ, শ্রবণেন্দ্রিয়ে জরা! কারণ শ্রী 'মনে মনে' জীবনের ৮৫ টি বসন্ত পেরিয়ে গিয়েছেন। বাঁশির ফুঁকও বেশ মলিন হয়েছে, টানা ১ মিনিটও বাজাতে বেশ বেগ পান। তবে সেই হাঁপধরা ১ মিনিটের বাঁশির আওয়াজেই আপনি ফিরে পেতে পারেন খোলা বাতাস আর অনন্তের প্রশান্তি।
ভাবছেন কোথায় পাবেন তাঁর দেখা? তাঁকে পেতে পারেন কালীঘাট মেট্রো স্টেশনের প্রবেশদ্বারে (গত কয়েক বছর মোটামুটি এখানেই নিয়মিত দেখা মেলে তাঁর), সেখানেই ঘন্টার পর ঘন্টা বসে একহাতে বাঁশিতে খেপে খেপে সুর তোলেন, আর এক হাত বাড়িয়ে দেন পথচলতিদের দিকে। জানালেন বাড়ি দূর-গঙ্গাসাগরে, এখানে বিধাননগরের কাছে কোনও এক ঝুপড়িতে কোনওমতে রাত-গুজরান। মাঝে মধ্যে দলের সঙ্গে নদীয়া, নবদ্বীপ, রানাঘাট করে বেড়ান।
ছেলেরা তো বারণ করে, তবু মন-টা না বাজিয়ে থাকতে পারেনা, সেই ১২ বছর থেকে শুরু, সংসার টেনেছি বাঁশি বাজিয়েই... এতদিনের 'ব্রহ্মজ্ঞান'...বলতে বলতেই চশমার ফাঁকে ঘোলাটে দৃষ্টি খানিকক্ষণ স্থির রেখে, কিছুক্ষণ থেমে ফের বাঁশিতে দিলেন ফুঁ, হাতে পড়ল ১, ২, ৫ টাকা।
মেট্রোর ব্যস্ততম সিঁড়িতে আমি তাঁর পাশে বসে এমন অসময়ে গল্প করছি দেখে এক গম্ভীর কন্ঠস্বর বলে চলে গেল, 'কাকা রাস্তা থেকে সরে যাও', বুঝলাম 'কাকা' নন, তাঁর নিত্যদিনের বসার সিঁড়িতে জায়গা বাড়িয়ে অসুবিধার সৃষ্টি করছি আমিই, তাই 'আবার আসব বাঁশি শুনতে' জানিয়ে তড়িঘড়ি উঠে পড়লাম আমি। গম্ভীর গলার হুঁশিয়ারি-আমার তড়িঘড়ি উঠে যাওয়া নিয়ে কিছু অপ্রস্তুত বোধ করছিলেনই মনে হল, হয়ত কথা বলতে বেশ ভালই বোধ করছিলেন তিনি। যে রাস্তায় বাঁশি শোনান রোজ, যাঁদের হাঁপধরা সুর শোনান অহরহ, তাঁদের বিরক্তি-গম্ভীর তাচ্ছিল্যের জবাব দেওয়ার সাধ-সাধ্য-অধিকার তাঁকে দেয়নি এ শহর-রাজপথ। তাই একবার ফোকলা হেসেই, ফের বাঁশিতে হাঁপধরা ফুঁ দিলেন 'হ্যামিলন' নয়, রাজপথের বুড়ো-ফকির এক বাঁশিওয়ালা।