দেশ স্বাধীন হল। পূব-বাংলার মানুষ, যাঁরা উদ্বাস্তু হলেন বা হলেন না; তাঁদের সকলের কাছেই স্বদেশটা দুম করে বিদেশ হয়ে গেল।
আসলে, সে এক বীভৎস রাজনীতি। ধর্মের জিগির তুলে দেশ ভাগ হয়েছিল, ধর্মের হানাহানি থেকে বাঁচতে হিন্দু-মুসলমান উভয়েই নিজস্ব নিরাপদ স্থান খুঁজে নিতে জন্মভিটে ছেড়ে এপার-ওপার বেড়া পারাপার করতে বাধ্য হয়েছিল অত্যন্ত অসহায় হয়ে। অনেকের মতো বরিশালের মুক্ত মাঠ পুরুষানুক্রমের স্মৃতিবিজড়িত ভিটে ছেড়ে কলকাতার অলিগলির গোলকধাঁধা পেরিয়ে বিডন স্ট্রিটে সপরিবারে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিলেন মোহিত চট্টোপাধ্যায়েরাও।
পরিবারে সদস্য অনেক। একটুকু বাসা। স্বল্প ভাড়ায় বাড়ি প্রায়শই প্রশস্ত হয় না। মোহিতদেরই বা তার অন্যথা হবে কেমন করে! পরিস্থিতি অবশ্য তাঁদের তামাম সহায়হীনের মতোই শিখিয়েছিল সেইটুকুর মধ্যেই বাঁচতে।
মোহিতের বয়স তখন মাত্র তের। ভিড়ের মাঝে বিভূঁইয়ে সঙ্গী কেবল পড়ুয়া মন। বাড়ির কাছে চৈতন্য লাইব্রেরী। সদস্য হয়ে যেতেই সুযোগ মিলল অবাধ পাঠের। দেশ-বিদেশের সেরা সেরা বই। মন খুলল, দিগন্ত বাড়ল। বাড়ির সংকীর্ণ সিঁড়ির এক চিলতে নির্জনতা হয়ে উঠল পাঠশালা। হয়ে উঠলেন নিবিষ্ট এক মাধুকরী পাঠক।
পাঠকই একদা লেখক হন। তাঁরও ক্রমে লিখনের সাধ জাগল। সস্তার কাগজ আর তার চেয়েও সস্তা কালি নিয়ে সিঁড়িই হয়ে উঠল সেই কিশোর লেখকের লিখনশালা।
কিশোর মনের খেয়ালে গড়ে উঠল প্রথম লেখা। উপন্যাস। ‘তোমার পতাকা তলে’। কোত্থাও কোনদিন ছাপা হল না। সম্ভাবনাও ছিল না। ছেলেমানুষি সেই লেখা কালের মন্দিরা শোনার আগেই হারিয়ে গেল চিরতরে।
চৈতন্য লাইব্রেরীর উদার দানে জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসুও ক্রমে এলেন পাঠতালিকায়। আধুনিক কবিতার দুই রথী। তাঁদের তিলোত্তমা পদাবলির শরীর বেয়ে বেয়ে একদা ছুঁয়ে ফেললেন কবিতার আত্মাকে। বুঝলেন, আত্মাকে ছুঁতে পারলে করগোনা ছন্দে কবিতাকে না-বাঁধলেও চলে। শুরু হল নিজস্ব ঢঙে গদ্যের বিভঙ্গে কবিতার আবাহন।
কলেজ পেরনো যৌবন অব্দি গেয়ে গেলেন আবাহনী গান। সিটি কলেজে সখ্যতা হল কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শিবশম্ভু পালের সঙ্গে। ‘কবিতা’য় সুনীলের কবিতা বেরিয়েছে, বুদ্ধদেব বসুর সাহচর্য মিলে গেছে এরই মধ্যে। বের করেছেন ‘কৃত্তিবাস’।
গড়ে উঠেছে কৃত্তিবাসী-আড্ডাও। শ্যামবাজার, কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে। সেই আড্ডায় ভিড়ে গেলেন মোহিত। সেখানে প্রাণ মিলল শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎ মুখোপাধ্যায়দের সঙ্গেও। নতুন স্বাদের কবিতায় মুগ্ধ করলেন তাঁদের। শুরু হল ‘কৃত্তিবাস’-এ আত্মপ্রকাশের হররা। প্রকাশিত হল, প্রথম কাব্য—‘আষাঢ়ে শ্রাবণে’। তারপর 'গোলাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ', 'শবাধারে জোৎস্না', 'অঙ্কন শিক্ষা' প্রভৃতি কাব্যময় মগ্নতার মধ্য দিয়ে কেটে গেল আরও দেড় দশক।
ছয়ের দশকে পিরান দেলোর নাটক এবং আরও কিছু বিদেশি অ্যাবসার্ড তাঁকে নতুন কিছু করতে প্রাণিত করল। প্রাণনা আসলে বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছিল প্রাণে, ছয়ের দশকে তা কায়ারূপ পেল।'গন্ধর্ব' পত্রিকায় ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম নাটক 'কণ্ঠনালীতে সূর্য'। এই নাটক পাঠ করে সচেতন নাট্যকর্মীরা একেবারে নড়েচড়ে বসলেন। কেননা, এতে এমনকিছু ছিল যা আগে বঙ্গধারায় তাঁদের চোখে পড়েনি।
আসলে এর মধ্য দিয়ে মোহিত বহমান বাংলা রিয়ালিস্টিক কাহিনিময় আবর্তের বাইরে এনে বাংলা নাটককে প্রথম দাঁড় করিয়ে মুক্তির স্বাদ দিতে সমর্থ হলেন। নিটোল কাহিনি বাতিল করে শুধুমাত্র কিছু মুহূর্ত সৃষ্টি করলেন নাটকে, সংলাপের আত্মায় রাখলেন কবিতার দ্যোতনা, সব মিলিয়ে একটা দারুণ অভিঘাত তৈরি করতে চাইলেন দর্শকের চেতনায়। পারলেনও। এই অভিঘাতটাই হল তাঁর বক্তব্য। নাটকে অভিঘাত নির্মাণের এই প্রকরণ বাংলায় তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি। নাট্যপরিচালক শ্যামল ঘোষ এই প্রকরণের নাম দিলেন, ‘কিমিতি’।'কিমিতি' হল 'কিম' ও 'ইতি'র ব্যাকরণমান্য সমন্বয়। যার অর্থ, 'এটা কী?'। অর্থের প্রশ্নটা আসলে দর্শকের নাড়া লাগা চেতনারই বহিঃপ্রকাশ।
'কিমিতি'র ধারা বেয়ে মোহিত একে একে রচনা করলেন 'চন্দ্রলোকে অগ্নিকাণ্ড' (১৯৬৬), 'সিংহাসনের ক্ষয়রোগ' (১৯৬৭), 'রাজরক্ত' (১৯৭১) , 'ক্যাপ্টেন হুররা', 'মহাকালীর বাচ্চা' প্রভৃতি যুগান্তকারী নাটক। চেতনার সংকট, সামাজিক সংকট এবং গভীর রাজনৈতিক সংকটের বলিষ্ঠ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর এই নাটকগুলো হয়ে উঠল সময়ের দলিল।
সাতের দশকের লোডশেডিংকালে মুক্তাঙ্গনে তাঁর 'রাজরক্ত' দেখার জন্য লোডশেডিংমুক্তির আশায় দর্শকের অনন্ত অপেক্ষার ঘটনা বুঝিয়ে দেয়, মোহিতের এই অভিঘাতমুখী নাটক শুধু সময়ের দলিল না, কাব্যময়তা পেরিয়ে সময়ের দাবি হয়ে উঠতেও পেরেছিল।
সাতের দশকে এসে কবিতার একক ভেলাকে বিদায় জানিয়ে নাটকের আঙিনাকেই আপন গৃহ করলেন মোহিত। কেন করলেন, তার কৈফিয়তও তিনি দিয়েছেন 'অনুষ্টুপ' পত্রিকায় দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে:
'...যে নাটকগুলো আমি লিখেছি সেগুলো সর্বাংশে, একশো ভাগ আমার, আমি সৃষ্টি করেছি। আমি কোন প্রথার সঙ্গে যাইনি। যেহেতু নাটক, তাই নাটকের সঙ্গে কতগুলো সাদৃশ্য তো থাকবেই। এটা সম্পূর্ণ আমার সৃষ্টি, আমি আমার মতো করে করেছি। দেখলাম কবিতাকে কিন্তু আমি এরকম নিজস্ব করে লিখতে পারিনি।'
নিজস্বতার আখর করতে না-পেরে কবিতা লেখা তিনি ছাড়লেন বটে, তবে সংলাপের ব্যঞ্জনাময় কাব্যধর্মীতা ও কবিতার পর্ব বিন্যাসকে নাটকের পরতে পরতে ছড়িয়ে রাখলেন। 'কিমিতি' পেরিয়ে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের নাট্যজীবনে কাহিনিধর্মী নাটকও তিনি প্রচুর লিখেছেন। নাটকের গান লিখেছেন। তবে তার চরণে চরণেও ছাপ রেখেছেন নিজস্বতার।
আসলে, তিনি চাইতেন উৎপল দত্ত বা শম্ভু মিত্রের নাটককে নিজস্ব প্রয়োগ-প্রকৌশল ও শৈলীর জন্য যেমন লোকে উৎপল দত্ত বা শম্ভু মিত্রের নাটক বলেই জানে; তেমনি তাঁর নাটককে লোকে 'তাঁর' নাটক বলেই জানবে। মোহিত প্রতিভার স্বকীয়তায় তাঁর সেই চাওয়াকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। তাই মোহিত চট্টোপাধ্যায় আজ শুধু বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসের একজন শরিকমাত্র নন, 'মোহিত চট্টোপাধ্যায়' চিরভাস্বর একটি অধ্যায়ের নাম...