সময়টা ১৯ শতক। বিতাড়িত, বিমর্ষ নিশাপুরি বংশের নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ অযোধ্যা হারালেন ৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৫৬, লখনউ ছাড়লেন সে বছরেরই ১৩ মার্চ, কলকাতা এলেন ৬ মে। তবে অনুমিত হয় যে তিনি প্রিন্সেপ ঘাটে নামলেও বাসস্থান না থাকায় এক রাত নৌকাতেই ছিলেন। বাসস্থানের খোঁজ পাওয়া যায় হুগলীর থেকে ২-২.৫ মাইল দূরে। সেখানে ছিল সম্ভ্রান্ত ইউরোপিয়দের ১৩টি বাগান বাড়ি। পরের দিন তার মধ্যেই ১১ নম্বর বাড়ি বর্ধমানের রাজা নবাব বাহাদুরের। তিনি ৫০০টাকার মাসিক ভাড়ার বিনিময়ে অযোধ্যার নবাবকে থাকতে দেন। তাঁর প্রতি ব্রিটিশ সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন ঠিক করলেও খুব বেশি কিছু করতে পারেন নি, মোটা মাসোহারা এবং সম্পত্তির কিছুটা ফেরত নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল। ইতিমধ্যেই মহাবিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং বিদ্রোহীরা যাতে সদ্য বিতাড়িত নবাবকে বিদ্রোহের নেতা হিসেবে প্রচার না করতে পারে তাই মিথ্যা অপবাদে তাঁকে ২৫ সপ্তাহের জন্য ফোর্ট উইলিয়ামে আটক করে রাখা হয়। ইতিমধ্যেই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, লর্ড ক্যানিং ভুল স্বীকার করে ১ লক্ষ টাকার মাসোহারা প্রদানের সমঝোতায় নবাবকে ছোট্ট রাজ্য গড়ে তোলার অনুমতি দেন। হুগলির কাছে গড়ে তুললেন নবাব ছোট লখনৌ, স্থাপত্য, খাবার, সংস্কৃতি, সাহিত্য পোষাক সবেতেই লাখনৌ ঘরানার বিকাশ ঘটালেন, তাঁর অপূর্ণ ইচ্ছে পূর্ণতা পেল।
গার্ডেনরিচের সাউথ-ইস্টার্ন রেলওয়ের হেডকোয়ার্টারের কাছে বি.এন. আর হাউস তার থাকার জন্য বরাদ্দ হয়, যা পরিখানা নামেই খ্যাত ছিল। সুলতান খানা, আসাদ মনজিল, মুরাসা মনজিল পান তিনি ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট থেকে এবং একাধিক বাগান বাড়ি নির্মাণ করেন লখনৌ স্টাইলে। তিনি বিদ্যাসাগর, মধুসূদনের সমসাময়িক ছিলেন, এককথায় বঙ্গে নবজাগরণের গতিশীলতার মধ্যেই ছিলেন কিন্তু ছোট লখনৌ শহরেই তাঁর নিজের জগৎ সীমাবদ্ধ ছিল, যার বিবরণ পাই হুতুম পেঁচার নকশা, গবেষণামূলক প্রবন্ধ, নবাবের নিজের লেখা বই থেকে। রোজি লিউলিন জোনস তাঁর ‘দ্য লাস্ট কিং ইন ইন্ডিয়া’ বইয়ে মেটিয়াবুরুজের ওয়াজিদ আলিকে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন সরকারি সূত্র থেকে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ করে। ওয়াজিদ আলির বিরুদ্ধে ব্রিটিশের আপত্তির প্রধান কারণ ছিল বিলাসিতা, রমণীবিলাস (সারা জীবনে তাঁর স্ত্রীর সংখ্যা প্রায় ৩৭৫ জন) ছাড়াও তাঁর নাচ-গানে অতিরিক্ত আসক্তি। অনেকে তাঁকে হিন্দুস্তানি থিয়েটারের প্রথম নাট্যকার বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কলকাতার নাট্য মঞ্চ তার দ্বারা খুব একটা প্রভাবিত হয় নি। তখনও তিনি নবাব হননি, ১৮৪৩ সালে ভাই সিকন্দর হাসমতের সম্মানে এক জলসার আয়োজন করেন ওয়াজিদ আলি। সেখানে নিজের লেখা নাটক ‘রাধা কানহাইয়া কা কিস্সা’ মঞ্চস্থ করেন। এই কিস্সাই প্রথম আধুনিক উর্দু নাটক। কৃষ্ণ ছিলেন তাঁর রোল মডেল। যমুনাতীরে পূর্ণিমা রাতে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের লীলা নবাবের চিরকালীন অনুপ্রেরণা ছিল। কৃষ্ণের রাসলীলা থেকেই লখনউয়ে ‘রহস’-এর সৃষ্টি। ওয়াজিদ আলির রহস বস্তুত অপেরা, যেখানে তিনি ব্রজ অঞ্চলে কৃষ্ণের জীবন নিয়ে নিজস্ব কত্থকের স্টাইল প্রচলন করেন। রহস হল নৃত্যনাট্য, যেখানে নির্দিষ্ট গল্প থাকত। লখনউয়ে নবাবির সময় ওয়াজিদ আলি মোট চারটি জলসার আয়োজন করেন, আর মেটিয়াবুরুজে ১৮৫৯ থেকে ১৮৭৫-এর মধ্যে অন্তত ২৩টি। ১৮৬১ থেকে মেটিয়াবুরুজে নিয়মিত ‘রাধা কানহাইয়া কা কিস্সা’ মঞ্চস্থ হয়েছে, সেখানে তা আরও পরিণত।
তবে কত্থক নাচের সংস্কৃতিকে ওয়াজিদ আলি যে স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন, কলকাতায় সেই লখনউ ঘরানাকে রসিক মহলে আদৃত করে তোলার পিছনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে সংশয়ের বিশেষ অবকাশ নেই। তিনি নিজে মহারাজ ঠাকুর প্রসাদের কাছে কত্থক শেখেন। ১৮৭৫-এ তিনি ‘মুসাম্মি বা বানি’ নামে কত্থক নিয়ে একটি সচিত্র বই লেখেন যা মেটিয়াবুরুজে লিথোগ্রাফ করে ছাপা হয়। কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি ও মুদ্রিত রূপ দু’টিই আছে। তাঁর সময়ে লখনউয়ে কত্থক শুধু হিন্দু শিল্পীদের মধ্যে আবদ্ধ ছিল না, মুসলিম শিল্পীরা একে গ্রহণ করে আরো পরিণত করেন। কলকাতায় তিনি লখনউয়ের অনেক শিল্পীকেই ডেকে নিয়েছিলেন। লখনউ ঘরানার কত্থকশিল্পীরা ওয়াজিদের সূত্রেই কলকাতায় সমাদৃত হন। শোনা যায়, ১৮৬৭-তে হোলির সময় মেটিয়াবুরুজের দরবারে ওয়াজিদ আলি স্বয়ং নর্তকীর বেশে নৃত্য পরিবেশন করেন, গেয়ে শোনান ঠুমরিও। ঠুমরির প্রচলন করেছিলেন তিনি, এমনকি মনের ভাব প্রকাশ যে রাগের মাধ্যমে সহজে হয় তেমন তাল ও রাগের প্রচলন করেন- ‘আখতারপ্রিয়া’ ছদ্মনামে তিনি একাধিক ঠুমরি রচনা করেন। হেকিম মোহাম্মদ করিম ইমামের 'মাদুল মুসকি’ গ্রন্থে এর বিস্তারিত বিবরণ আছে। লখনউয়ে ওয়াজিদ আলির দরবারেই ঠুমরি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছয় যা মেটিয়াবুরুজ থেকে ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার বুকে। এমনকী দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত ‘বাঙালীর গান’-এও (১৯০৬) ওয়াজিদ আলির লেখা তিনটি গান ঠাঁই পেয়েছে, সব চেয়ে বিখ্যাত বোধহয় ‘যব ছোড় চলে লক্ষ্ণৌ নগরী’।
সংগীতবেত্তা রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর (১৮৪০-১৯১৪) পাথুরিয়াঘাটা থেকে মেটিয়াবুরুজ যেতেন লখনউ ঠুমরির টানে। যদুনাথ ভট্টাচার্য বা যদুভট্ট, অঘোরনাথ চক্রবর্তী নবাবের দরবারি ঠুমরির রীতিমত ভক্ত ছিলেন। বস্তুত ওয়াজিদ আলির দাক্ষিণ্যে মেটিয়াবুরুজ হয়ে উঠেছিল ধ্রুপদী কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। ‘তারিখ-ই-পরিখানা’-য় ওয়াজিদ লিখেছেন, তিনি বিখ্যাত সেতারি কুতুব আলি খানের কাছে সেতার শেখেন। উস্তাদ বসত খান মেটিয়াবুরুজে রবাব নিয়ে আসেন। সুরশৃঙ্গারও তাঁরই আনা, ওয়াজিদ এই যন্ত্রটিকে জনপ্রিয় করেন। ওয়াজিদের আহ্বানে কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দরবারে সুরবাহার বাজিয়েছিলেন। এই দরবারেই উস্তাদ নিয়ামতুল্লা খান আধুনিক সরোদ সৃষ্টি করেন। এগারো বছর তিনি ওয়াজিদ আলির কাছে ছিলেন। ওয়াজিদ তবলাকেও এ শহরে জনপ্রিয় করেন। সানাই, এসরাজের সঙ্গেও জড়িয়ে তাঁর নাম।
এখানেই শেষ নয়। চিড়িয়াখানার ধারণা তাঁর মস্তিষ্ক প্রসূত, প্রতি মাসে ৯০০০টাকা খরচ হতো পশু সংরক্ষণে। ঢিমে আঁচে রান্না তিনিই নিয়ে আসেন কলকাতায়, বিশেষ করে বিরিয়ানি। বিরিয়ানিতে আলুর প্রচলনও তাঁর হাতেই কি না, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। লখনউ পানের কদর আজও কম নয়। তাম্বুলবিলাসী হলেও নবাব মদ বা আফিম স্পর্শ করেননি। ২১ সেপ্টেম্বর ১৮৮৭ চলে গেলেন ওয়াজিদ আলি শাহ। ইংরেজ তাঁর রাজ্য কেড়ে নিয়েছিল, কিন্তু ওয়াজিদ আলি তাঁর জীবনচর্যায় কোনও তালভঙ্গ হতে দেননি। দেননি বলেই আমাদের সংস্কৃতি আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। তার মৃত্যুর পর ব্রিটিশ সরকার তাঁর স্মৃতি মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেন, তবে যা আছে তা সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের শিকড়সন্ধানের যথাযথ সহায়ক ।