ভারতের প্রথম টিউবশিশুর বাবা সুভাষ মুখোপাধ্যায়

বেঁচে থাকতে ইতিহাস তৈরি করেছিলেন তিনি, জীবন্ত-কিংবদন্তি হয়ে ওঠার চমৎকার যোগ্যতা তাঁর ছিল; কিন্তু হয়ে উঠতে পারেননি। বলা ভালো, তাঁকে জীবন্ত-কিংবদন্তি হয়ে উঠতে দেওয়া হয়নি। শাসক, প্রতিক্রিয়াশীল এবং ধান্দাবাজের দল যখন গাঁটছড়া বাঁধে; তখন ইতিহাস থমকে যায়। মধ্যযুগের পাশ্চাত্যে এর প্রচুর নজির আছে, আধুনিক যুগে বাংলায় এর শিকার চিকিৎসক সুভাষ মুখোপাধ্যায়

সুভাষ মুখোপাধ্যায় টিউবশিশুর বাবা। এই অর্থেই 'বাবা' যে, তিনিই ভারতে প্রথম (বিশ্বে দ্বিতীয়) টেস্টটিউব বেবির জন্মদাতা, চিকিৎসক। যাকে বলে, 'ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন' পদ্ধতি, ভারতে তার প্রবর্তক সুভাষ।

আসলে, ছাত্র হিসেবে সুভাষ ছিলেন দারুণ প্রতিভাবান। অধিকাংশ পরীক্ষাতেই প্রথমস্থান অধিকারী। দেশ-বিদেশের কৃতী গবেষক। চিকিৎসাবিদ্যায় স্ত্রীরোগ, প্রজনন বিভাগ ও  লিউটিনাইজিং হরমোন বিশেষজ্ঞ।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসাবে সুভাষ দেখেছিলেন যে, কতশত দম্পতি শারীরিক সমস্যার কারণেই পিতামাতা হয়ে উঠতে পারেন না। ফলে, একটি অপূরণীয় অপূর্ণতায় তাঁরা সারাটা জীবন কাটাতে বাধ্য হন। এই ব্যাপারটা একদিন তাঁকে বেশ ভাবিয়ে তুলল। ভাবনা থেকেই তাদের এ-সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে সুভাষ খুঁজতে শুরু করলেন সম্ভাবনাময় পথ। এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন গবেষণা।

ক্রমাগত গবেষণায় সুভাষ একসময় বুঝলেন যে, অক্ষম পিতামাতার সুস্থ শুক্রাণু ও ডিম্বাণু যদি বিশেষ আবহে টেস্টটিউবে নিষিক্ত করে ভ্রূণকোষের জম্ম দিয়ে মায়ের গর্ভে প্রতিস্থাপন করা যায়, তাহলে মা তাকে ধারণ করে অবশ্যই জন্ম দিতে পারবেন। সুভাষ যখন গবেষণালব্ধ এই সিদ্ধান্তটিকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, ঠিক সেই সময়ই একদিন প্রভাত আগরওয়াল ও বেলা আগরওয়াল নামের এক দম্পতি সন্তানধারণের সমস্যা নিয়ে তাঁর কাছে হাজির হলেন।

তিনি পরীক্ষা করে দেখলেন যে, এই দম্পতির ওপর তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চিকিৎসা করলে সফলতার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে, তিনি দম্পতিকে তাঁর ইচ্ছের কথা জানালেন। তাতে এক যুগ ধরে অনেক চিকিৎসকের দরজা-ফেরৎ এই দম্পতিও যেন আশার আলো দেখলেন। স্বভাবিকভাবেই তাঁরা সহজেই রাজি হয়ে গেলেন। ব্যস, ডাক্তার সরোজ ভট্টাচার্যসুনীত মুখোপাধ্যায়ের সক্রিয় সহায়তায় শুরু হয়ে গেল সুভাষের নতুন দিগন্ত আঁকার প্রস্তুতি।

অন্যদিকে প্রায় এই একইসময়ে ইংল্যান্ডে রবার্ট এডওয়ার্ডস নামের এক চিকিৎসা-বিজ্ঞানীও এই টেস্টটিউব বেবি-বিষয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন। যদিও তাঁর মতো উন্নত যন্ত্রপাতির সম্ভার ও প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য, কোনটাই সুভাষের কাছে ছিল না; তবুও বাড়ির ফ্রিজ, নিজস্ব ল্যাবের সাধারণ যন্ত্রপাতি আর সরকারি হসপিটালে চাকরির মাইনেটুকুর বিনিময়ে গোপন গবেষণার মাধ্যমে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দের ৩ অক্টোবর তিনি কলকাতার বুকে জন্ম দিলেন ভারতের প্রথম টেস্টটিউব বেবি, সুস্থ-সবল কন্যাসন্তান দুর্গার। ভারতের প্রথম, কেননা এর ঠিক সাতষট্টি দিন আগে রবার্ট এডওয়ার্ডসও সফলতার সঙ্গে লুইজ ব্রাউন নামের একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়ে ফেলেছেন। তাই সুভাষ হলেন দেশে প্রথম, বিশ্বে দ্বিতীয়। তিনি যদি এডওয়ার্ড-এর মতো সুযোগ-সুবিধে পেতেন, তাহলে ইতিহাসটা হয়তো সেদিন উল্টো হত...

যাই হোক, সুভাষ অসাধারণভাবে সফল হলেন। এবার সমস্ত গোপনীয়তা ভেঙে গবেষণার সুফলের কথা সকলকে জানিয়ে দিতে, সকলের কাছে এই চিকিৎসাপদ্ধতি উন্মুক্ত করতে উদ্যোগ নিলেন। কিন্তু তিনি ভাবলেন এক, হল আরেক। তাঁর সফলতার খবর পেতেই কলকাতার বন্ধ্যাত্ব-ব্যবসায়ী নামিদামি চিকিৎসকের দল শুরু করল ঘোঁট পাকাতে। তাদের মনে হল, সুভাষের সফলতা তাদের ব্যবসা নষ্ট করে দেবে। সুভাষের সুনাম তাদের পসার নষ্ট করবে। তাদের প্রতিপত্তি অনেক। ফলে, রচিত হল ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রে হাত মেলাল রাজ্যের তৎকালীন শাসক ও মিডিয়ার একাংশ।

অবিলম্বেই তারা সুভাষের গবেষণা ভিত্তিহীন ও মিথ্যে প্রমাণ করে ছাড়ল। কর্মক্ষেত্রে সুভাষকে একা করে দিল। সরকারের তরফ থেকে অধীতবিদ্যার বাইরে অন্য চিকিৎসা বিভাগে তাঁকে বদলি করে দেওয়া হল। তাঁর গবেষণাপত্র বিশ্বের কোনও জার্নালে প্রকাশ ও বিদেশযাত্রার ব্যাপারে সমস্তরকম নিষেধাজ্ঞা জারি করা হল। এভাবেই তাঁকে সবরকমভাবে একঘরে রাখার ব্যবস্থা করা হল। মধ্যযুগের বর্বরের দল বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে তাঁর প্রগতিচিন্তার জন্য যেমন কারারুদ্ধ করে একাকীত্বের অন্ধকারে শেষের পথে ঠেলে দিয়েছিল; একালের বর্বরেরা সুভাষের সেই দশা করল।

ক্রমাগত অপমান-অসহযোগিতায় সুভাষ ভয়ানকভাবে ভেঙে পড়লেন। এই অবস্থায় ইচ্ছে করে তাঁর ওপর কর্মক্ষেত্রে প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হতে লাগল। এরই মধ্যে সমবেত এই অত্যাচার সহ্য করতে না-পেরে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন একদিন। অসুস্থতার জন্য ছুটি চাইলেন, তাও না-মঞ্জুর হয়ে গেল। সেই সঙ্গে পরিস্থিতি যখন আরও দুর্বিষহ করে দেওয়া হল, তখন আর পারলেন না, নিজেকে শেষ করে দেওয়ারই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন সুভাষ। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুন মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলেন।

নিষ্ফল অভিমানে এভাবেই তিনি চলে গেলেন। নীরবে। পিশাচেরা উল্লাসে করে স্তব্ধ হল। তাঁর সমস্ত কৃতিত্ব ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হল কালের কালো ধুলোয়। আটের দশকের শেষদিকে সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী যদিও তাঁকে নিয়ে উপন্যাস লিখলেন 'অভিমন্যু' নামে; নয়ের দশকের শুরুতে তপন সিনহা ছবি বানালেন 'এক ডক্টর কি মউত' নামে; তাতে আগ্রহী হয়ে  সাধারণ কিছু মানুষ হয়তো জানল সুভাষের কৃতিত্বের কথা, কিন্তু স্বীকৃতি তো এল না।

স্বরাজ্যের মানুষ যখন সুভাষকে একেবারেই ভুলে গেল, তখনই তাঁর স্বীকৃতির জন্য সোচ্চারে লড়াই করলেন ভিনরাজ্যের এক কৃতী। তামিলনাড়ুর বৈজ্ঞানিক-চিকিৎসক টি সি আনন্দকুমার। আনন্দকুমার নিজে ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে 'হর্ষ' নামের টেস্টটিউব বেবির সার্থক জন্মদাতা। সুভাষের কৃতিত্বকে বাংলাতেই এমনভাবে চেপে দেওয়া হয়েছিল যে, আনন্দকুমার প্রায় কাছাকাছি সময়ে এ-ধারার চিকিৎসক হয়েও সুভাষের কথা জানতে পারেননি।

তবে আনন্দকুমার যখন সফল হলেন, তখন সমগ্র তামিলনাড়ুতে হৈ চৈ পড়ে গেল। মানুষ উল্লসিত হয়ে উঠলেন। সেই উল্লাসের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র দেশে। ভারত সরকার তাঁকে ভারতের প্রথম টিউবশিশুর জনক হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন।

এর কিছুকাল পরেই আনন্দকুমার কলকাতায় এলেন।একটি সেমিনারে যোগ দিতে। সেই সুযোগে সুভাষের গবেষণা-সহায়ক ও চিকিৎসক সুনীত মুখোপাধ্যায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন, সুভাষের কৃতিত্বের কথা তাঁকে জানালেন এবং তাঁর হাতে সুভাষের গবেষণার কাগজপত্র তুলে দিলেন। সেগুলো পড়েই আনন্দকুমার নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলেন যে, সত্যই তিনি নন, এ-পথে প্রথম সুভাষই। তখন তিনিই উদ্যোগী হলেন সুভাষের কৃতিত্ব আদায়ের লড়াইয়ে।

অবিলম্বে 'ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ'-এ সমস্ত প্রমাণসহ পেশ করলেন দাবি। তারই প্রেক্ষিতে একদা সুভাষের কৃতিত্ব স্বীকৃতি পেল। ভারতের প্রথম টেস্টটিউব বেবির জনক হিসাবে সরকারিভাবে ঘোষিত হল ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নাম। আর, সেই সঙ্গে ভারতের প্ৰথম টেস্টটিউব বেবি হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন দুর্গা, ওরফে কানুপ্রিয়া আগরওয়াল।

সুভাষ শুধু প্রগতির পথে কালো অধ্যায় পেরনো এক কিংবদন্তি পথিকৃৎ নন, তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার আলো কখনই নেভে না; যার আলো মানুষের মনে জাগিয়ে রাখে সনাতন আশার আলো। কেননা, তাঁর পথ ধরেই সারা দেশে আজ প্রায় চারশো ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন ক্লিনিক কতশত নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটিয়ে চলেছে নিত্য, কতশত বাবামায়ের শূন্য কোল ভরিয়ে দিচ্ছে অন্তহীন আলোয়। এই আলোই তো দেখতে চেয়েছিলেন, দেখাতে চেয়েছিলেন সুভাষ। বঞ্চনার দেশে তাঁর এটুকু স্বপ্ন অন্তত সত্যি হয়েছে, এটাই সান্ত্বনা...

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...