কোথাও খরা, কোথাও মাত্রাধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত। এইমূহুর্তে ঠিক এইরকমই পরিস্থিতি ভারতে। সম্প্রতি অসমে ঘটে যাওয়া বন্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন ৫৫ লক্ষেরও বেশি মানুষ। শুধু তাই নয়, একটি বিশাল সংখ্যক বন্যপ্রাণীকূল আজ বিপন্ন। এদের মধ্যে রয়েছে বাঘ, হাতি, এক শৃঙ্গ ভারতীয় গন্ডার, হরিণ সহ বিভিন্ন বন্য প্রজাতি।
কাজিরাঙ্গা অভয়ারণ্য একশৃঙ্গ গন্ডারদের বৃহত্তর সংখ্যার আবাসস্থল। আসাম বন্যার প্রভাব কাজিরাঙ্গার দিকে এগোতেই এই অভয়ারণ্যের ৪৩০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার ৯০ শতাংশ জলের তলায় চলে যায়। এর ফল হয় ভয়াবহ। ভারতীয় একশৃঙ্গ গন্ডার সহ বেশ কিছু প্রাণীকে কিছু চোরা শিকারির দল মিলিত প্রচেষ্টায় অপহরণ করার চেষ্টা করে।
সংসদে পেশ করা একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা গিয়েছে ২০১৩ সাল থেকে কাজিরাঙ্গায় এই পর্যন্ত ৭৫টি গন্ডার হত্যা করা হয়েছে। অসমের পরিবেশ ও অরণ্য মন্ত্রী অতুয়া মুন্ডার বক্তব্য, ২০১৩ সালে ৩৭টি গন্ডারকে হত্যা করার খবর রয়েছে। ২০১৪ সালে এই হত্যার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২টি ও এই বছরের ৮ মার্চ পর্যন্ত মোট ৮টি গন্ডারকে হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৫৪টি গন্ডার হত্যা করা হয়েছে কাজিরাঙ্গা অভয়ারণ্যে, ৬টি গন্ডার মানস জাতীয় উদ্যানে ও ৫টি গন্ডারকে হত্যা করা হয়েছে ওরঙ্গ জাতীয় উদ্যানে।
যদিও ইতিমধ্যেই ওয়াইল্ড লাইফ রিহ্যাবিলিটেশন এন্ড কনভেনশন ( সিডাব্লিউআরসি), ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়া (এনজিও) এবং অসম বন বিভাগের যৌথ উদ্যোগে সেখানকার বন্যপ্রানীদের নিরাপদ রাখার পাশাপাশি আহতদের প্রাণীদের যত্নশীল চিকিৎসার যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন।
"ভারতের অভয়ারণ্যের ১৫ জনের একটি দল এবং অসম বন দপ্তরের একাংশ এখানে সবসময় ঘোরাফেরা করছে। যখনই যা কিছু দরকার পড়ছে, অবস্থা ও পরিস্থিতি অনুসারে আমরা তখনই একটি দলকে সেই ঘটনাস্থলে পাঠিয়ে দিচ্ছি। এটা অনেকটা নির্ভর করছে ঠিক কোন ধরণের প্রাণী সেখানে বিপর্যস্ত হয়েছে।"
- ডাক্তার রথিন বর্মন, ট্রেনিংপ্রাপ্ত ওয়াইল্ড লাইফ বায়োলজিস্ট, ওয়াইল্ড লাইফ রিহ্যাবিলিটেশন এন্ড কনভেনশনের প্রধান( সিডাব্লিউআরসি)।
তিনি আরো বলেন, "আমাদের দলের চারজন লোক এই বিশেষ অভিযানের সাথে যুক্ত। এঁদের মধ্যে তিনজন ডাব্লিউটিয়াইএ'র এবং একজন বন দপ্তরের কর্মী। একটি গন্ডার শাবক আমাদের ওয়াইল্ড লাইফ রিহ্যাবিলিটেশন এন্ড কনভেনশনে রয়েছে এবং বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে যতটা সম্ভব তার খেয়াল রাখা হচ্ছে।"
সিডাব্লিউআরসি গত উনিশ বছর ধরে কাজিরাঙ্গা অভয়ারণ্যে আহত ও উদ্ধারকৃত বন্যপ্রাণীদের সেবার কাজ করে চলেছে।
"ফ্রন্টলাইনে থাকা কিছু স্থানীয় গ্রামবাসীদের থেকে আমরা প্রথম আহত এবং ‘সারভাইবার’ প্রাণীদের খবর পাই। পরিস্থিতি ও ঘটনা মোতাবেক আমরা একটা উদ্ধারকারী দলকে সড়ক অথবা জলপথে পাঠিয়ে দিই। একবার ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেলে আমাদের পশু চিকিৎসকরা তখন মিলিত হয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেন। এটা যদি ছোটোখাটো কোনো ক্ষুদ্রতর দূর্ঘটনা হয়ে থাকে তবে সেখানেই যাবতীয় চিকিৎসা প্রণালী শুরু করা হয়। তারপর তাকে মুক্ত করা হয়। অথবা এটা যদি কোনও বড় ধরণের সমস্যা হয়, তখন প্রাণীটিকে আমরা তৎক্ষনাৎ আমাদের রেস্কিউ সেন্টারে স্থানান্তরিত করে দিই। এবং যতদিন না প্রাণীটি পুরো সুস্থ হচ্ছে, আমাদের তত্ত্বাবধানেই থাকে। এই মূহুর্তে যেমন আমাদের সেন্টারে দু’টি গন্ডার শাবকসহ মোট দশটি পশু রয়েছে।"
তিনি পরে যোগ করেন, "এটা স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত নয়। এটা বন্যারও বেশি কিছু, যা কাজিরাঙ্গাকে ক্রমশ ধ্বংস করছে। এই অভয়ারণ্যে নদীর জন্য বৃষ্টির প্রয়োজন। কারণ এটা বাস্তুতন্ত্রের একটি অংশ। তাছাড়া পশুরা এইভাবেই অভ্যস্ত। কিন্তু এটি ক্রমশ ভয়াবহ হয়ে উঠছে..। এই পরিস্থিতি বন্যপ্রাণীদের ক্রমশ তাদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল থেকে গ্রামে এবং মহাসড়কগুলোর দিকে যেতে বাধ্য করছে। এইবছর জাতীয় উদ্যানের বাইরের পরিস্থিতিও ভয়াবহ । এইভাবেই হয়তো ধীরে ধীরে বন্যপ্রাণীদের সংখ্যা হ্রাস পাবে। তবে গত বছরের নিরিখে দেখতে গেলে এবছরে এখনও অবধি মৃত্যুসংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। শুক্রবার পর্যন্ত এই বছরে মোট ৬০ থেকে ৭০ টি বন্যপ্রাণীর নথিভুক্তকরণ সম্ভব হয়েছে। মৃতের সংখ্যা অন্যান্য বছরগুলোর তুলনায় কম। বিগত বছরগুলোতে মৃতের হার তুলনামূলকভাবে অনেকটাই বেশি ছিল। গত কয়েক বছর ধরে এটা নিয়ে আমরা মানুষের সঙ্গে লাগাতার কাজ করে চলেছ।"
রবিবার পর্যন্ত অভয়ারণ্যে মৃত পশুর সংখ্যা বেড়ে ২১ হয়েছে। এদের মধ্যে ১৪টি হরিণ, ৩টি সাম্বার, ৩টি বুনো শুয়োর ও একটি বন মহিষের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে।
প্রসঙ্গত, কয়েকদিন আগেই অসমের সোনার মেয়ে হিমা দাস বন্যা পরিস্থিতির জন্য নিজের বেতনের অর্ধেক দান করে অন্যান্য সমস্ত বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থা ও ব্যক্তি মানুষদের সাহায্যের অনুরোধ জানিয়ে, টুইট করে একটি দৃষ্টান্তমূলক নজির গড়েছিলেন। আর ইতিমধ্যেই বন্যা বিধ্বস্ত অসমের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বেশ কিছু উদ্যোগী মানুষ। কিন্তু বন্যায় ক্রমশ ধ্বংসের স্রোতে ধাবিত হচ্ছে কাজিরাঙা অভয়ারণ্য।