শম্ভু তখন বছর নয়েক, যখন তার বাবা বাড়ি ছাড়ে। কাজের সন্ধানে বিহার থেকে দিল্লি আসতে হয় তাদের।
হজরত নিজামুদ্দিন স্টেশনের পাশে একটা ঝুপড়িতে আশ্রয় নেয় শম্ভুরা। অভাবের সংসারে খাবার জোগাড় করতে হিমশিম বাবা। শম্ভু নিজেই কাজ খুঁজে নেয় স্টেশন চত্বরে। তার ‘শম্ভু’ নামটা ক্রমশ চাপা পড়ে যেতে থাকে। বদলে মেলে নতুন নাম ‘দুবলা বিহারী’। রাগে ক্ষোভে কান্না এলেও দুবেলা-দুমুঠো ভাতের জোগান বজায় রাখতে গিলে ফেলতে হত কান্নাগুলো।
আবার এক নতুন নাম পেয়েছে শম্ভু।হজরত নিজামুদ্দিন স্টেশন চত্বরে এখন তাকে ডাকে ‘এডিটর সাহাব’ বলে।
শম্ভু ‘বালক নামা’র সম্পাদক। দিল্লি থেকে প্রকাশিত দ্বিভাষিক এক সংবাদ পত্রের দায়িত্বে আছে সে।
শম্ভু এখন সতেরো। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে জাংপুরায় বেশ কয়েকটা গাড়ি ধুয়ে তারপর সে কাগজের দফতরে আসে।
কাগজের খুঁটিনাটি নিজের হাতে দেখে। বালকনামার সদ্য প্রকাশিত কপির গায়ে হাত বুলিয়ে বলে, ‘এটা আমাদের কাগজ। আমাদের কথা আমরা নিজের মুখে বলতে পারি এখানে।’
বেশিরভাগ মানুষ আমাদের এমনভাবে এডিয়ে যায়, তাদের কাছে আমরা রাস্তার ময়লা ঘেন্নার। কারণ আমরা কাগপজ কুড়াই। ভিক্ষে করি। আমাদের কাজ নিয়ে আমাদের কোনও লজ্জা নেই। যে কাজ করে এসেছি, সেই কাজই করব।
২০০৩ এর সেপ্টেম্বরে প্রথম প্রকাশিত হয় বালকনামা। আট পৃষ্ঠার মাসিক সংবাদপত্র। শুরুতে অবশ্য তিন মাস অন্তর প্রকাশিত হত । শুরুতে সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৫ জন। এখন ১৬ বছর ধরে একইভাবে চলছে। পথশিশুদের দ্বারা, পথশিশুদের জন্য প্রকাশিত সংবাদপত্রের নজির ভারতে আর নেই। পৃথিবীতেও প্রথম।
শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, শিশুনিপীড়ন, পথশিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের মতো গুরুতর বিষয়ে খবর করা হয়।
দিল্লি দিল্লি, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন শহরের সংবাদ প্রকাশ করা এই। ভারতের ৪ টি রাজ্যে বালকনামার প্রায় ৬০ জন রিপোর্টার আছে। বয়স ১২ বারো থেকে কুড়ি। কোন স্টোরি যাবে, কোন অ্যাঙ্গেলে যাবে, সম্পাদকীয়র ফোকাস কী হবে সব ঠিক করে এই সব ‘রাস্তার’ শিশুরাই। লেখা থেকে এডিটিং সবটাই ওরাই করে।
শুরুটা অবশ্য সহজ ছিল না। এই সংবাদপত্রে রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার জন্য অভিভাবকদের অনুমতি আদায় সহজ হয়নি। পরে ছেলেমেয়েদের লেখা আর ছবি খবরের কাগজে দেখে তাঁরা আর বাধা দেননি। অনেকের জীবন বদলে গিয়েছে ‘বালকনামা’য় কাজ করতে এসে। বালকনামা’য় যারা কাজ করে তারা কেউ টাকা পায় না। বরং নিজেদের কন্ঠকে বাঁচিয়ে রাখতে নিজেদের আয় থেকে কাগজের চাঁদা দেয় তারা।
বালকনামা’কে যারা ধরে রেখেছে সেই সব শিশুদের কথায়, ‘মূলধারা মিডিয়া সেলিব্রিটিদের কুকুর-বেড়ালের গল্প দেখায়, কিন্তু স্টেশনের কোন পথশিশু শীতের রাতে ঠাণ্ডায় জমে মারা গেলে সে খবর দেয় না। আমরা কেমন আছি তাতে তাদের কিছুই যায় আসে না, তাই আমাদের কথা আমরা এভাবেই বলতে চাই।’ সেভাবে আমাদের কথা বলে না।