নারায়ণের গল্পলেখার আখ্যান

'পাশাপাশি', সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা দ্বিতীয় গল্পের নাম। বড় করুণ সেই গল্প। শ্রোতাদের প্রায় সব্বার ভালো লেগেছিল, চোখে জল এনে দিয়েছিল। তবু গল্পটি নেই। আর কোনদিন সেটি পাওয়া যাবে না। কারণ, স্বয়ং লেখক পাণ্ডুলিপিটি কুচি কুচি করে ছিঁড়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কেন তিনি এমনটা করেছিলেন, সে এক ইতিহাস। বলছি।

বাবা প্রমথনাথ পেশায় পুলিশ হলেও ছিলেন বেশ সাহিত্যপ্রেমী মানুষ। দিনাজপুরের বাড়িতে বড় একখানা লাইব্রেরী তৈরি করেছিলেন। নামকরা সব সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। ফলে, ছোট থেকেই বাবাকে পড়তে দেখে সাহিত্যের পাঠক হয়ে উঠেছিলেন নারায়ণও।

সাহিত্য এমন জিনিস, যে খালি তাল বুঝে নিবিষ্ট ও গুণী পাঠককে লেখক হতে উস্কোয়। তারই উস্কানিতে নারায়ণ কলম ধরলেন। কবিতা এগোতে লাগল তরতর করে, পছন্দ না-হলেই ছিঁড়তে লাগলেন ফরফর করে। এমনিভাবেই চলতে লাগল খেলা লেখা, লেখা খেলা। 

কবিতা লেখা তো হতে লাগল। এবার সাধ জাগল, সে-সব যাতে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু, বালকের সেই সাধ পূরণের ভার নেবার মতো কেউ ছিল না। থাকবে কী করে? লেখালেখি সবই যে চলে লুকিয়ে লুকিয়ে, বড়রা টেরই পায় না। তাই নিজের সাধ নিজেকেই পুরাবার ভার নিতে হল। সাহিত্য পত্রিকার অনুকরণে নিজেই একখানা পত্রিকা বের করে ফেললেন। হাতে-লেখা মাসিক পত্রিকা। নাম দিলেন, 'চিত্র-বৈচিত্র্য'। নিজেই লেখক, নিজেই ছাপক, নিজেই পাঠক। লেখা হতে লাগল এক কপি করে।

ক'দিন পর টনক নড়ল। সাহিত্য পত্রিকায় শুধু কবিতা তো থাকে না, গল্পও থাকে। রহস্য গল্প পাঠক টানে বেশি। সুতরাং, 'চিত্র-বৈচিত্র্য'র পাতা ভরাতে লেখা শুরু করলেন ধারাবাহিক রহস্য গল্প। খেল-বন্ধু সুধীন সেই গল্প শুনে একেবারে মোহিত হয়ে গেল।

শুধু মোহিত নয়, পত্রিকার গ্রাহকও হয়ে গেল নগদ এক আনা দিয়ে। নারায়ণ পেলেন সবেধন পাঠক এবং 'চিত্র-বৈচিত্র্য' পেল সবেধন গ্রাহক। অবশ্য এর কিছুদিন পর সুধীন যখন হঠাৎ কলকাতায় পড়তে চলে গেল, তখন পাঠক ও গ্রাহক হারিয়ে 'চিত্র-বৈচিত্র্য' বন্ধ হয়ে গেল, রহস্য গল্পও শেষ হল না। ক্রমে দুটোই হারিয়ে গেল কালের স্রোতে।

এবার বলি দ্বিতীয় গল্পের কথা। স্কুলের মারকুটে অঙ্কের স্যার গোপী রায়ের ক্লাসে নারায়ণ ঠাঁই নিতেন লাস্ট বেঞ্চে। গণিতে তাঁর যেরকম ব্যুৎপত্তি, তাতে সেখানেই নিজের জন্য নিরাপদ আসন নির্দিষ্ট করে নিয়েছিলেন। এবং এই বিদঘুটে পিরিয়ডটি আঁকাযোগ, কবিতাযোগ প্রভৃতি নানারকম যোগে কাবার করে ফেলতেন। কিন্তু, সেদিন হল তাঁর গল্পযোগ। লিখে ফেললেন দ্বিতীয় গল্প, 'পাশাপাশি'। 

গল্পটি পাশাপাশি দুটি বাড়িকে নিয়ে। একটি বড়লোকের বাড়ি, অন্যটি গরীবের। বর্ষার রোমান্টিক আবহে বড়লোকের বাড়িতে যখন টি-পার্টি চলছে, অন্যদিকে তখন গরীবের ছেলেটি বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে-এই হচ্ছে গল্পের বিষয়। ততদিনে বন্ধু এবং ভাইবোনদের কাছে কবি-সাহিত্যিক হিসেবে একটু পাত্তা পেতে শুরু করেছেন নারায়ণ; ফলে, বাড়ি ফিরে নবকীর্তিটি তাঁদের সামনে এনে সটান হাজির করলেন। শুধু হাজিরই করলেন না, পাঠ করে শোনালেনও। 

পাঠ শুনে সবারই চোখে যখন জল চিকচিক করতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন নারায়ণের এক পিসতুতো দাদা। ফুচুদা। দার্জিলিংবাসী সাহেবি মানুষ তিনি। বড়লোকদের টি-পার্টির খাবার তালিকায় নারায়ণ রেখেছিলেন মাংসের কচুরি। তাই শুনেই ফুচুদার অমন হাসি।

মাংসের কচুরি বলে নাকি কিছু হয় না! ওটা নাকি হাস্যকর অবাস্তব! তাঁর কথা এবং তার সঙ্গের বিচ্ছিরি অট্টহাসিতে নারায়ণের সাহিত্যিকসত্তা আহত হল। চোখের কোণ চিকচিক করে উঠল। ভাইবোনদের মুগ্ধতা দেখে যে-গল্পটিকে অসাধারণ সৃষ্টি বলে মনে হচ্ছিল এতক্ষণ, এবার সেটাকেই নির্বোধ প্রহসন বলে মনে হল। অমনি পাণ্ডুলিপি ছিঁড়ে কুটিকুটি করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেন। 'পাশাপাশি' চিরকালের জন্য হারিয়ে গেল হালের হাওয়ায়!

মাংসের কচুরির কথা কোথাও একটা শুনে গল্পে লিখেছিলেন নারায়ণ। এই ঘটনার পর বহুকাল ভেবেছেন, হয়তো ভুল শুনেছেন। কিন্তু, এই ভুলেরও ভুল ভাঙল বিয়ের পর। স্ত্রীর হাতে তৈরি মাংসের কচুরি খেয়ে। বুঝলেন, মাংসের কচুরি মোটেই অলীকবস্তু নয়। বুঝলেন, ক্ষণিক আবেগে গল্পটির পাণ্ডুলিপি ছিঁড়ে ফেলে যে ভুল তিনি করেছেন, তা শোধরানোর আর উপায় নেই। গল্পটি ফের হয়তো লিখে নেওয়া যায়, কিন্তু, বালককালের সেই মনটিকে তিনি ফেরাবেন কেমন করে!...

যাই হোক, আহত নারায়ণ তারপর গল্প লেখা ছেড়েই দিয়েছিলেন। তবে কবিতা লেখার কামাই ছিল না। নামকরা সব সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করল। পাঠকের কাছে পরিচিত হলেন কবি হিসেবেই। ঠিক তখনই 'দেশ' পত্রিকার সহ-সম্পাদক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের তাড়ায় আবার গল্পে ফিরতে বাধ্য হলেন।

'দেশ' পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত যে গল্পটি দিয়ে কবি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম গল্পলেখক হিসেবে বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে পরিচিত হলেন; সেই গল্পের নাম, 'নিশীথের মায়া'। জন্মকালের বিচারে এটি তাঁর তৃতীয় গল্প। দ্বিতীয় গল্পে পিসতুতো দাদা অট্টহাসি হেসেছিলেন, তৃতীয় গল্পে মহাকাল মুচকি হাসলেন। কেননা, নারায়ণের কবিকৃতি আজ হারিয়ে গেছে, তাঁকে বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে তাঁর গল্পের ধারা।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...