হিরের নাকছাবি। মাথায় ঘোমটা। মুখে পান। মঞ্চ আলো করে এক ঈশ্বরী। গানের ধারায় ডুবে। সেই মুহুর্তে সামনে সুর ছাড়া আর কোন অবয়ব নেই। ভরা মঞ্চে তিনি একলা। তিনি মালিকা-ই-গজল। গান করেন যখন মনে হয় রাতের বুক চিরে একলা কোকিল বিলাপ করে চলেছে। আখতারী বেগম। জ্যোৎস্না পথে সুরের যাদু বিছিয়ে তাঁর আজীবনের চলন।
গান তাঁর কাছে শুধু মাত্র গান ছিল না। আসলে অন্তরের নৈবেদ্য। সেই নৈবেদ্য আপন ঈশ্বরের প্রতি। সত্য, সুন্দরে যার বাস। আর বোধহয় বেদনায়। চূড়ান্ত অনিশ্চিতায় ভাসমান জীবন, নিয়তির পথেই যেন একদিন ছুঁয়ে ফেলেছিলেন এক কিন্নরীর আঁচল। তারপর থেকে কেবলই সুরের আশ্রয়ে ভেসে চলা।
বাবা স্বীকৃতি দিতে চাননি। জীবন কার্যত শুরু করেছিলেন ফৈজাবাদের এক রেলস্টেশন থেকে। ঘরহারা মা আর মেয়ে। দুঃখ-দারিদ্র্যে প্রায় বিপর্যস্ত জীবন। কোন দিকে যে স্রোত গড়াবে কোনও আন্দাজ নেই।
মুশতারি বেগম তাঁর মা ফয়জ়াবাদ হাইকোর্টের মুনসেফের মেয়ে। ব্যারিস্টার অসগর হুসেন তাঁকে নিকা করেছিলেন আইন মেনেই। কিন্তু প্রথম পক্ষের স্ত্রী বিয়ের অনুমতী দেননি অসগর সাহেবকে। তাই বাড়িতে ঠাঁই মেলেনি মুশতারি বেগমের। তিনি রয়ে গিয়েছিলেন ফৈজাবাদে। দুই যমজ কন্যা হল তাঁর। জ়োহরা আর বিব্বী আখতার সৈয়দ। চার বছর বয়সে মারা যায় জোহরা। মিষ্টির মধ্যে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে দেওয়া হয় তাকে। অভিযোগের তির বাবার পরিবারের দিকে।
এমন ট্র্যাজেডি বারবার এসেছে আখতারের জীবনে। বেদনা তাঁকে ক্লান্ত করতে পারেনি। সমস্ত বেদনাকে কণ্ঠে ধারণ করতেন। প্রেম, বিচ্ছেদ, যন্ত্রণা গান হয়ে জেগে উঠত হৃদয়ের নিভৃতে।
অর্থাভাব, সংকট থেকে বাঁচতে তীব্র লড়াই শুরু থেকেই। সেভাবেই গানের দুনিয়ায় আসা। বিখ্যাত উস্তাদ জামির খাঁ-র কাছে সেখানে তালিম নেওয়া শুরু করে ছোট্ট বিব্বী। মাত্র ১৩ বছর বয়সে পেয়েছিলেন দেশ জোড়া খ্যাতি। তাঁর সেই উত্থান নিয়ে মিথ কম নেই।
তাঁর জীবন ব্যাপি ঘটনার ঘনঘটা। কেবল রক্তপাত। যত বেশি ক্ষত-বিক্ষত হয়েছেন তত বেশি করে গানকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন। যতবার গান ছাড়তে চেয়েছেন ততবার ভার বেড়েছে ক্ষতের।
তখন লক্ষৌতে থাকেন। গান গেয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। জীবনে বদল এসেছে। পেল্লাই এক বাড়ি বানালেন। ঠিক নাম দিলেন আখতারি মঞ্জিল। সেই বাড়ির উল্টোদিকের বাড়িটাই জাস্টিস আসগর হুসেনের বাড়ি। সম্পর্কে তাঁর জন্মদাতা। একদিন নিজের সৎভাইয়েই আবিষ্কার করেছিলেন গানের আসরে। কেউ কেউকে চেনে না!
গানের জন্য নাম বদল করতে হয়েছিল। স্বামীকে লুকিয়ে গান রেকর্ড করতেন। বিয়ের শর্ত ছিল গান ছেড়ে অভিজাত পরিবারের আদর্শ বধূ হয়ে উঠতে হবে। রেডিয়োতে তাঁর গান প্রচারিত হয়েছিল ‘আখতারী’ নামে নয়, ‘বেগম আখতার’ নামে।
তাঁর গজলে মুগ্ধ হয়েছে শ্রোতাঁরা। সুরে ভেসেছে। হেসেছে। কেঁদেছে। প্রেমহারা প্রেমিকে গান দরিয়ায় ভেসে বারবার ফিরতে চেয়েছে প্রেমের কাছে। সুরের আলোয় ছেয়ে যাওয়া ভুবনে, শ্রোতারা কোনওদিন জানতে পারেনি কোন পাষাণের বুক ভেঙ্গে বয়ে যাচ্ছে এমন সুরের সুরধনী। সে কথা কেবল রুদ্ধদ্বারের ওপারে রক্ত স্মৃতির আখর। বেগম আখতার গেয়ে চলেন,
“কুছ তো দুনিয়া কী ইনায়ত নে দিল তোড় দিয়া
কুছ তো তলখি-ই-হালাত নে দিল তোড় দিয়া
হাম তো সমঝি থি বরসাত মেঁ বরসেগি শরাব
আয়ি বরসাত তো বরসাত নে দিল তোড় দিয়া”