চেনা সলিলের অজানা আলো

এক



সলিল চৌধুরী ও ঋত্বিক ঘটকের বন্ধুত্বের গল্প অনেক। তার মধ্যে একটা বলি। যে-সময়ের কথা, তখন সলিল বম্বের ব্যস্ত সুরকার। 



সময়টা, ১৯৬০ সাল। 



ঋত্বিক নতুন ছবি বানাবেন। ছবির নাম দেবেন, 'কোমল গান্ধার'। এ-বছর তাঁর 'মেঘে ঢাকা তারা' রিলিজ করেছে, ছবিটা 'হল'-এ এখনও হৈ হৈ করে চলছে। ফলে, ছবিটা থেকে ঋত্বিকের ইতিমধ্যেই বেশ দু'পয়সা হয়েছে। দীর্ঘ অসফলতার শেষে এই ব্যাপক সাফল্য ঋত্বিককে নতুন ছবি তৈরির ব্যপারে প্রচন্ডরকম উৎসাহিত করল।

SalilChowdhury2

সেই উৎসাহে ফুটতে ফুটতে তিনি গেলেন সলিল চৌধুরীর কাছে। বম্বের ব্যস্ততার ফাঁকে সলিল অনেকদিন পরে ক'দিন হল কলকাতায় ফিরেছেন।   



বেপরোয়া ঋত্বিক তাঁর বাড়িতে গিয়েই ভালোমন্দ চুলোয় তুলে তুড়ি বাজিয়ে বললেন, এক্ষুনি একটা রোমান্টিক গান লিখে দে তো, কুইক...নেক্সট ছবির জন্য।  



সলিল হাসলেন, এক্ষুনি বললেই কী আর এক্ষুনি হয়, এই তো এলি, এতদিন পর দেখা, বস, চা খা, তারপর না হয় লেখা নিয়ে বসছি...। 



কিন্তু ঋত্বিকের তাতে তর সয় না। সবসময় একটা ছটফটানি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় যেন তাঁকে। সলিল সেটা হাড়ে হাড়ে জানেন। তাই 'এক্ষুনি'টাকে ম্যানেজ করতে জমিয়ে আড্ডা শুরু করে দিলেন।

 

আড্ডা জমলে ঋত্বিক একেবারে অন্য মানুষ। বেমালুম ভুলে গেলেন গানের কথা। তখনকার মতো 'এক্ষুনি'টা পার করে পরে সলিল অবশ্য ঋত্বিককে একখানা রোমান্টিক গান লিখে দিয়েছিলেন এবং সেই সঙ্গে তৈরি করেছিলেন সুরও।  



কিন্তু গানটি তৈরি হলেও ছবিতে আর ব্যবহার করা হয়নি। পরবর্তীকালে অবশ্য ননফিল্মি রেকর্ডগীতি হিসেবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে গানটি খুব জনপ্রিয় হয়। এই গানটি হল-'আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা'। বাংলা ভাষায় সেরা দশটি প্রেমের গানের মধ্যে এই গান একটি।



কারণ, এ-গান একইসঙ্গে প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয় ছুঁয়ে সমাজজীবনের হৃদয়ে পৌঁছে দেয় নতুন দিনের আহ্বান।      

SalilChowdhury3

দুই



এটা আর-একটু আগের কথা। সলিল তখন পুরোদস্তুর গণনাট্য সংঘের সঙ্গীত স্কোয়াডের কর্মী। তিনি গণনাট্যের নাটকে-গানে অসাধারণ সব সুর দিচ্ছেন। তাতে তিনি অনেক শ্রোতার কাছে পৌঁছচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু একজন সমাজ সচেতন সঙ্গীতকার-সুরকার হিসেবে তো তাঁকে তার বাইরের শ্রোতার কাছেও পৌঁছতে হবে। 



এই ভাবনা থেকেই তিনি সেই সময়ের রেডিও ও সিনেমার বিখ্যাত গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে নিজের কথা ও সুরে একটা গান রেকর্ড করতে চাইলেন।  



গণনাট্যের সাথে হেমন্তও যুক্ত। ফলে, আলাপ আছে। সেই ভরসায় একদিন হেমন্তর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে বেশকিছু গান শোনালেন সলিল।  কিন্তু হেমন্তর কেমন যেন পছন্দ হল না সে-সব গান। তিনি গতের বাইরে অন্য ধরণের গান চান--যা এই সময়ের হয়েও সবকালের সাধারণের কথা বলবে।

SalilChowdhury

সলিল একরকম হতাশ হয়েই চলে আসছিলেন। কিন্তু, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ কিছু একটা ভেবে তিনি থেমে গেলেন। থমকে ফিরলেন হেমন্তর দিকে। হেমন্ত তখন সলিলকে এগিয়ে দিতে এসে সিঁড়ির মাথায়। সলিল তাঁকে বললেন, একটা গান লিখছি, এখনও শেষ হয়নি...তবে আপনি যা চাইছেন আমি বুঝতে পেরেছি, ও গান তেমনই...  



হেমন্ত বললেন, বাহ, তাহলে এখনই শোনাও সে গান। 



সলিল আবার ফিরলেন হেমন্তের ঘরে। গান শোনালেন। 



সে-গান শুনে হেমন্ত চূড়ান্ত মুগ্ধ হলেন। তাঁর মনে হল, এই গান গাওয়ার জন্যই যেন তিনি এতদিন অপেক্ষা করে ছিলেন!



আর কোথাও কোন বাধা রইল না। সলিলের সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম রেকর্ড করলেন। রেকর্ডে যে গানটি গাইলেন, তা হল-'কোন এক গাঁয়ের বধু'। 



গানের রেকর্ড প্রকাশিত হতেই তা তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠল। ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল সে-গান। গণনাট্যের মঞ্চ বেয়ে তা পৌঁছে গেল বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। গানটি এতটাই সমাদৃত হল যে, সর্বভারতীয় শ্রোতাদের জন্য অবিলম্বে এর একটি হিন্দি ভার্সানও রেকর্ড করতে হল। 



আসলে সেই সময় কলকাতাসহ সারা বঙ্গদেশে দুর্ভিক্ষ ও দাঙ্গায় কৃষিজীবী মানুষের সর্বহারা হয়ে যাওয়ার যে-ছবি এই গানে তুলে ধরা হয়েছে, তা যেন সমসময়কে ছুঁয়ে এক চিরন্তন মানবিকতাকে স্পর্শ করেছে। তাই এই গানটি হয়ে উঠেছে আপামরের চিরদিনের গান...



ঋণ : প্রথম গল্পটি অধ্যাপক ও ঋত্বিক-বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে পাওয়া।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...