রামমোহন রায়: বলিষ্ঠ এক ঋজুচরিত্রের রাজা

রামমোহন শুধু বাঙালি নন, নিছক ভারতীয়ও নন; তিনি আমূল আন্তর্জাতিক। অবশ্য এ আমরা সবাই জানি। আর জানি অসাধারণ পণ্ডিত, দার্শনিক, তার্কিক, সংস্কারক এই মানুষটি কোনদিনও দ্বিধাচারী ছিলেন না, অন্যের দ্বিচারিতা কখনো সহ্যও করতেন না। তাঁর চরিত্রের এই দৃঢ় দিকটি নিয়ে সেকালে কত গল্পই না লোকের মুখে মুখে ফিরত! আজও ফেরে কারও কারও মুখে...

রামমোহন তখন তাঁর মানিকতলার বাড়ির বাসিন্দা। তা, সেই বাড়িতে তাঁর মতো শাস্ত্রজ্ঞ - পণ্ডিত মানুষের কাছে কত লোক আসেন শাস্ত্র আলোচনা করতে, কত লোক আসেন তর্কে তাঁকে পরাজিত করে আত্মতৃপ্ত হবার ব্যর্থ সাধনা করতে। তেমনই এক স্মার্ত - পণ্ডিত ভটচাযমশাই সাগরেদসহ সকাল সকাল একদিন হাজির হলেন তাঁর বাড়িতে। রামমোহন তখন দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজছেন। বেশ। ভটচাযমশাই তাঁর অতিপরিচিত লোক। তাই মুখ থেকে দাঁতন বার করে ভটচাযমশাইকে আপ্যায়ন করে বসিয়ে সেই দাঁতনেই আবার দাঁত মাজতে মাজতে গেলেন মুখ ধুতে। দাঁতন মুখ থেকে বের করে আবার সেই দাঁতনেই দাঁত মাজার ব্যাপারটি  ভটচাযমশাই খেয়াল করেননি, খেয়াল করলেন ভটচাযমশাইয়ের এক সাগরেদ। তিনিই গুরুর কানে তুললেন। ব্যস, আর দেখতে হল না। ভটচাযমশাই এদ্দিন তক্কে তক্কে ছিলেন, এবার নগদ সুযোগ পেলেন খুঁত ধরার। তিনি মনে মনে খুশি হলেন। কিন্তু, মুখে বেশ বিরক্তির ভান করে জানালেন, 'এ আপনার কেমন ব্যবহার রায়মশাই! শাস্ত্রজ্ঞ লোক হয়েও এঁটো কাঠে মুখ ধুচ্ছেন! শাস্ত্রমতে এ যে অনাচার, সে নিশ্চয় আপনি বিস্মৃত হননি!'

রামমোহন আচার মানেন, কিন্তু অযৌক্তিক অপ-আচার মানেন না। তাই ভটচাযমশাইয়ের কথায় তিনি বিরক্ত হলেন। কিন্তু, সেটা বাইরে প্রকাশ করলেন না। এমনকি কোন উত্তরও দিলেন না। খোদ রামমোহনকে চুপ করিয়ে দিতে পেরে ভটচাযমশাই বাগ বাগ খুশি হলেন এবং বুক ফুলিয়ে সাগরেদদের কাছে গেলেন। ভাবটা এমন, যেন: 'কি হে, দেখলে তো কেমন দিলাম!' 

খানিক পরে রামমোহন মুখটুখ ধুয়ে ভটচায এন্ড কোং-এর কাছে এসে বসলেন। শুরু হল শাস্ত্র-আলোচনা, কূট-তর্ক; কিন্তু, দাঁতন সম্পর্কে আর একটা কথাও হল না। রামমোহন শুধু তাঁর কাজের লোকটিকে বললেন ভটচাযমশাই ও আর সব্বার জন্য তামাক সেজে দিতে। ভৃত্য তামাক সেজে দিল, তামাক টানার জন্য একখানা গড়গড়ার নলও দিল। ভটচাযমশাই নল মুখে মৌজ করে গুড়ুক গুড়ুক তামাক টেনে তর্ক চালাতে লাগলেন। খানিক সময় যেতে না যেতেই তামাক শেষ হল। রামমোহন খাতির করে ভৃত্যকে আবার তামাক সাজতে বললেন। ভৃত্য নতুন গড়গড়ায় তামাক সেজে এনে পুরনো নলটিই লাগিয়ে দিল। আর অমনি ভটচাযমশাইও নলটি ফের মুখে দিয়ে আগের মতোই মৌজ করে গুড়ুক গুড়ুক আওয়াজ তুলে তামাক টানতে শুরু করলেন। জাতে যাঁরা বামুন, রামমোহন তাঁদের 'দেবতা'-বলে সম্বোধন করতেন। ভটচাযমশাই তামাক টানা শুরু করতেই সেই সম্বোধনেই রামমোহন তাঁকে চমকে দিলেন। বলে উঠলেন, 'দেবতা! এ আপনার কেমন ব্যবহার! আমাকে উপদেশ দিয়ে নিজে কেন বিপরীত আচরণ করছেন! এঁটো কাঠ দ্বিতীয়বার মুখে দিয়ে আমি যদি অন্যায়-অনাচার করে থাকি, তাহলে আপনিও তো তা-ই করলেন! দাঁতনের মতো গড়গড়ার নলের মুখটিও তো কাঠের তৈরি, সেটি প্রথমবারের তামাক খাওয়াতে উচ্ছিষ্ট হয়েছে কি না!' মোক্ষম যুক্তির প্যাঁচে এবার ভটচাযমশাই কাবু। উত্তরই দিতে পারলেন না। নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই পড়ে এমন লজ্জিত হলেন যে, সাগরেদ সমুখে আর মুখ তুলতে পারলেন না!

বাড়ির আগেপিছে রামমোহনের বাগানটি ভারি সুন্দর, তাতে কত রকমের ফুলের যে বাহার, তার যেন আর তুলনা নেই। সেই বাগানে এক পূজারী বামুন সাজি নিয়ে ফুল তুলতে আসেন রোজ। তিনি ভক্তজন, কাজেই সেলাই করা কাপড় পরেন না, ধুতির ওপর গায়ে চাদর দেন। তা, বামুনটি ফুল তোলার আগে চাদরটি একটি গাছের ডালে ঝুলিয়ে রেখে প্রতিদিন ফুল তোলেন। আবার ফুল তোলা হয়ে গেলে চাদরটি ডাল থেকে নিয়ে গায়ে দিয়ে চলে যান। কিন্তু, একদিন ফুল তুলে তিনি চাদরটি আর দেখতে পেলেন না। অমনি 'হায় হায়'-করে এমন হাপিত্যেস করতে শুরু করলেন যে, পাড়া মাথায় ওঠার জোগাড় হল! তাই শুনে বাড়ির ভেতর থেকে কৌতূহলী হয়ে বেরিয়ে এলেন রামমোহন। বামুনের হাপিত্যেস শুনে বুঝলেন, এটি বাড়িরই কোন কাজের লোকের দুষ্টুমি। তিনি কাজের লোকদের বললেন বামুনের চাদরটি ফিরিয়ে দিতে। অমনি চাদরটি তারা ফিরিয়ে দিল। রামমোহন বললেন, 'চাদরটি পেয়ে আপনি খুশি তো, দেবতা?' বামুন খুশিই হয়েছিলেন, কিন্তু, রামমোহনের প্রশ্ন কী জানি কেন, হঠাৎ তিনি যেন শাস্ত্রজ্ঞ দার্শনিক হয়ে উঠলেন। বললেন, 'নিজের জিনিস পেয়েছি, এতে আর খুশির কী আছে!' তাঁর এই কথাটাই রামমোহনকে ভ্রুকুঞ্চিত করতে বাধ্য করল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, 'এই যে সাজিতে ফুলগুলি তুলেছেন, বলুন তো এগুলি কার?' বামুন বললেন, 'কার আবার, ঈশ্বরের।' রামমোহন আবার প্রশ্ন করলেন, 'এগুলো কাকে নিবেদন করবেন?' বামুন বললেন, 'কেন, ঈশ্বরকে!' রামমোহন পুনরায় প্রশ্ন করলেন, 'তা, এগুলো পেয়ে তিনি খুশি হবেন তো?' বামুন ঝটপট উত্তর করলেন, 'হবেন বৈকি, নিশ্চয় হবেন!' রামমোহন এবার মুচকি হেসে বললেন, 'ঈশ্বরের জিনিস ঈশ্বরকে দিলে ঈশ্বর খুশি হবেন কেন!'--এ কথা শুনে বামুনের যেন এবার সম্বিৎ ফিরল। বুঝলেন, কী কুক্ষণে সে রাজার সঙ্গে দর্শনের ভাবকবিত্বে নেমেছিল!

 

গল্পঋণ : 'মহাত্মা রাজা রামমোহন রায়' - নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...