কলকাতা তাঁর কর্মক্ষেত্র। কিন্তু তিনি কোনওদিনই কলকাতায় থাকতে চাননি। কখনও ভাবেননি মহানগরের স্থায়ী বাসিন্দা হবেন তিনি। তবু থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁর বইয়ের জন্য। বিপুল বইয়ের ভান্ডার ছিল তাঁর।
সেই সময়ের সেরা ব্যক্তিগত লাইব্রেরি ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। মূল্যবান সংস্কৃত গ্রন্থ এবং পুঁথি তো ছিলই। বাংলা, ইংরেজি, ফারসি, হিন্দি ভাষার প্রায় ষোল হাজার বই ছিল। আলাদা করে উল্লেখ করতেই হয় ইউরোপে শিক্ষা সংস্কার নিয়ে বইয়ের সংগ্রহ।
শিক্ষা ব্যবস্থাকে বদলাতে গেলে তা গোড়া থেকেই বদলাতে হবে। তাঁর এই ভাবনার ফসল ‘বর্ণপরিচয়’ আর ‘প্রথম ভাগ’। প্রকাশকাল ১৮৫৫। ভারতে প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ পাঠ্যপুস্তক।
বিদ্যাসাগরের সমস্ত সামাজিক কর্মকান্ডের ভিত্তি ছিল তাঁর লাইব্রেরি।
সেকালের হিসাবে অন্তত লক্ষাধিক টাকার বই ছিল সংগ্রহে। এমনিতে বিদ্যাসাগর মিতব্যয়ী ছিলেন তাঁকে সে সময়ের মিতব্যয়ীতার আইকন বলা হত। কিন্তু আতুরের সাহায্য আর বই সংগ্রহ-এই দুই দিকে তাকালে তাঁর উদার হস্তে খরচের পরিচয় মেলে। আসলে মিতব্যয়ী থেকে তিনি এই সব কাজে খরচ করার অৰ্থ মজুত করতেন।
ছোটবেলায় বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রথম কলকাতায় এসেছিলেন। শিক্ষা-কর্মজীবন- পরিচিতি- সামাজিক কর্মকান্ড সব এখানেই। কিন্তু বিদ্যাসাগর কোনোদিনই নিজেকে কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে ভাবতে চাননি। তাঁর স্থায়ী বাস মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামেই। তাই কলকাতায় নিজের বাড়ির কথা ভাবেননি। প্রথম জীবন কাটিয়েছেন একের পর এক ভাড়াবাড়িতে। কিন্তু ভাড়াবাড়ির আস্তানা ক্রমশ তাঁর বইয়ের জন্য অপ্রতুল হয়ে উঠতে লাগল। লাইব্রেরির আয়তন যত বাড়তে লাগল তাঁর একটা বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে লাগল আস্তানার পরিসর।
কোন উপায় না করতে পেরে শেষ পর্যন্ত কলকাতায় একটু বড় মাপের বাড়ি তৈরির কথা ভাবতে শুরু করলেন। সংগ্রহের বই আর দুষ্প্রাপ্য পুঁথিগুলো যথাযথ ভাবে সংরক্ষণ করা বাড়ি নির্মানের প্রধান এবং একমাত্র উদ্দেশ্য।
কিন্তু বারবার দ্বিধা। মনের সুতোয় বীরসিংহের টান। দেশের মাটির গন্ধ যদি ফিকে হতে শুরু করে- হাজার এক সংশয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না কিছুতেই। শেষ পর্যন্ত বীরসিংহ নিবাসী বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হলেন।
ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় পুত্র ঈশ্বরচন্দ্রের জন্য তৃপ্তিবোধ করতেন। নিজের উচ্চশিক্ষার খেদ মিটেছিল পুত্র কে দেখে। পিতা পুত্রকে বললেন, “পুস্তক রাখিবার উপলক্ষে তুমি বাটি প্রস্তুত করিবে, এ সংবাদে সন্তোষলাভ করিলাম। ত্বরায় বাটি প্রস্তুতের উদ্যোগ করো।”
পিতার অনুমতি পেয়ে বিদ্যাসাগর ২৫ নম্বর বৃন্দাবন মল্লিক লেনে বই রাখার বাড়ি তৈরি করলেন। সময়টা ১৮৭৬। প্রায় ১৪ বছর বিদ্যাসাগর ওই বাড়িতে ছিলেন। ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই এই বাড়িতেই মারা যান।
শুধু মাত্র বই এর জন্য কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
পরবর্তী সময়ে রাজ্য সরকার বাড়িটি অধিগ্রহণ করে। বিদ্যাসাগর উওমেন্স কলেজের হাতে বাড়িটি তুলে দেওয়া হয়।
বিদ্যাসাগর স্মৃতি রক্ষার গড়া ট্রাস্ট অর্থ সংকটে পড়লে লালগোলার মহারাজা বিদ্যাসাগরের সংগ্রহের বই কিনে নেন। পরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে রাখা হয়।