স্বপ্ন যখন বাস্তবতা পায়

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর গেটের সামনের ফুটপাতে একটি ছোট পুরোনো বইয়ের দোকান চালান পুণ্যবাবু। হ্যাঁ, ভালো নাম তাঁর পূর্ণেন্দু ঘোষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের ফুটপাত দিয়ে যাওয়ার সময় তার দোকান চোখে পড়েনি এরকম লোক খুব কমই আছেন। এই পুণ্যবাবুকে শুধু দোকানের বিক্রেতা ভাবলে কিন্তু মস্ত ভুল করা হবে। পেশায় তিনি বই বিক্রেতা হলেও নেশায় কিন্তু তিনি লেখক। বইয়ের দোকান চালানোর পাশাপাশি তিনি ইতিমধ্যেই লিখে ফেলেছেন সুন্দরবনের একাংশের ইতিহাস। বইটি হাতে পেয়ে তাকে নিয়ে যথেষ্ট আশাবাদী গবেষকগণ। তার গল্পই আজ আমরা বলবো আপনাদের।

পুণ্যবাবু নিজেই জানিয়েছেন তাঁর জীবনের নানা গল্প। তিনি জানিয়েছেন কোথা থেকে তিনি পান এতো লেখার অনুপ্রেরণা। ক্যানিং থানার অন্তর্গত পূর্বদিঘীর পাড় নামক একটি গ্রামে জন্মেছিলেন বলে মাটির টান ছিল। সেই এলাকার পাশ দিয়েই বয়ে যেত মাতলা নদী। আর্থিক অবস্থা মোটের উপর ভালোই ছিল তাদের। কিন্তু ১৯৪৩ সালে এক ভয়ানক বন্যায় বাড়িঘর সবকিছু চলে যায় জলের তলায়। তারপর থেকেই অভাব ও অনটন হয় তার নিত্যসঙ্গী। সেই অভাব আর মেটেনি। কলেজের গন্ডি পর্যন্ত গিয়েই পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয় তাঁকে। তখন থেকেই অর্থ উপার্জনের জন্য বেরিয়ে পড়তে হয়। তিনি নিজেই জানান, সারাজীবন ধরে তিনি অর্থকষ্ট মেটানোর জন্য কি কি কাজ করেছেন। তিনি ট্রেনে হকারি করেছেন, মাটির প্রতিমা গড়েও বাজারে বিক্রি করেছেন। আর সবশেষে তিনি বইয়ের দোকান খুলেছেন। প্রায় দেড় দশক হয়ে গেলো তিনি এই বইয়ের দোকান নিয়েই রয়েছেন। এরই মাঝে চলছে তাঁর লেখালেখির কাজ।

তিনি জানালেন, কখনো খুব খারাপ ছাত্র তিনি ছিলেন না। তাই লেখার কাজে কোনো অসুবিধা হয়নি। বরং লেখাকেই তিনি তাঁর জীবনে চলার পথের অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েছেন। পুন্য বাবু জানান, তিনি প্রথম দেওয়াল পত্রিকায় লিখেছেন। তারপর ছোটপত্রিকায় তিনি লেখার কাজ করতেন। তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় বাংলার প্রথম সারির একটি পত্রিকায়। পত্রিকায় লেখার সুবাদে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বদের সাথে আলাপ হয়। তাঁদের থেকেও লেখার কাজে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তিনি। তার সবচেয়ে আলোচিত বইটি হলো 'ইতিহাসের আলোকে সুন্দরবন ও পোর্ট ক্যানিং'। সুন্দরবন এলাকায় জনবসতি গড়ে ওঠা নিয়েই মূলত এই বইটি। এই কাজটি করার জন্য তার জীবনের প্রায় ২০ বছর তিনি অতিক্রান্ত করে ফেলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, অভাবের সংসারে তার উপার্জনই শেষ কথা। সেখানে দাঁড়িয়ে উপার্জনের পাশাপাশি একটি বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে গবেষণা করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু তিনি কাজের ফাঁকে ফাঁকেই দৌড়ে বেড়িয়েছেন সুন্দরবনের বিভিন্ন অলিগলি। তার এই কাজকে কুর্নিশ জানাচ্ছেন গবেষকমহলও।  

  আঠার ভাটির গাঙ্গের কড়চা, স্থানীয় পরিবহন, শিক্ষা, বাজার, মৎস বন্দর, নৌশিল্প, ধর্মমত, সাহিত্য, রাজকাহিনী, ঘরবাড়ি, প্রভৃতি বিচিত্র তথ্য নিবন্ধিকরণে সুন্দরবনের মুখবন্ধ রচিত হয়েছে এই বইতে। কবি জীবনানন্দের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি হারিয়ে গিয়ে ক্যানিং শহরের এক মুদিখানায় চলে আসে। যদিও একেবারে নষ্ট হওয়ার আগেই তা উদ্ধার হয়। বইটি পূর্ণেন্দু বাবুর ২০ বছরের গবেষণার ফসল। দিনের পর দিন পড়ে থেকেছেন গ্রন্থাগারে তথ্য আহরণ করার জন্য। পুণ্যবাবুর প্রথম বইয়ের নাম 'রাখাল বন্দনা'। ১২টি গল্পের একটি সংকলন। কিশোরদের পড়ার উপযোগী কলকাতার ইতিহাস লেখেন 'গল্পকথায় কলকাতা'। তবে তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ অবশ্যই 'ইতিহাসের আলোকে সুন্দরবন ও পোর্ট ক্যানিং'

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...