মাত্র একশো পরিবার নিয়ে একটা ছোট্ট জনপদ এই চড়িদা। পুরুলিয়া শহরের সীমানা পেরিয়ে অযোধ্যা হয়ে আপনি চলে আসতে পারেন এই গ্রামে। স্থানীয় কোনো মানুষ কে সাহায্যের জন্য না নিয়ে গেলে আপনার পথ ভুল হতে পারে।
কারণ খুব আশ্চর্য়ের বিষয়, পুরুলিয়ার ছৌ যে মুখোশের জন্য প্রসিদ্ধ, সেই মুখোশের আঁতুর ঘর চড়িদার কথা সাধারণ মানুষ শোনেনি বললেই চলে। এখানেই একের পর এক ছোট ছোট বাড়ির উঠোন জুড়ে শুধুই রঙ বেরঙের মুখোশ। শহুরে জীবন ছেড়ে হঠাৎ এখানে গিয়ে পড়লে একটাই কথা মনে হবে, হ্যাঁ এটাই তো একমাত্র শিল্প যা একান্তই আমাদের ।ছৌ-এর বিষয়ে আরও একটা তথ্য জানা দরকার। ভারতের অন্যতম প্রসিদ্ধ এবং সবচেয়ে পুরনো লোকনৃত্য ছৌ-এর ঠিকানা আক্ষরিক অর্থে দুটি। ওড়িশার ময়ুরভঞ্জ এবং পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া। কিন্তু এই দুই ধরণের ছৌ নৃত্যকে আলাদা করে তোলে একটাই বিষয়- মুখোশ । ময়ুরভঞ্জ ছৌ-নাচে মুখোশের ব্যবহার নেই। আর পুরুলিয়া ছৌ কে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করেছে তাঁর মুখোশ এবং সাজপোশাক।
চড়িদা গ্রামে ঢুকতেই সরু রাস্তার দুধার জুড়ে চোখে পড়বে অধিকাংশ কাঁচা এবং খুব অল্প কয়েকটি পাকা বাড়ি। প্রত্যেকটি বাড়ির দাওয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাটির মণ্ড। কোথাও কাগজ পেতে রোদে শুকোতে দেওয়া সদ্য তৈরী মুখোশ।একটা মুখোশ বানাতে সময় লাগে অন্তত পাঁচদিন। মাটি তোলা, সেই মাটিতে মুখোশের আকার দিয়ে তা শুকোতে দেওয়া-এতেই প্রায় দিন তিনেক সময় চলে যায়। তারপর মাটিতে রঙের প্রলেপ। তা শুকোলে সব শেষে এখানকার মুখোশের ট্রেডমার্ক, অর্থাৎ জরি-চুমকির কাজ।
২০১৫ সালে ছৌ মুখোশ শিল্পী সংঘ এর উদ্যোগে এই গ্রামেই একটি তিন দিনের বিরাট মেলার আয়োজন হয়েছিল। সেখানে এক একটা স্টল হয়ে উঠেছিল প্রত্যেক শিল্পীর দালান। যে গ্রামের নাম প্রায় কেউই জানতো, সেখানে ভিড় উপচে পড়ার মতো হয়েছিল।আলোয় ভরে উঠেছিল চারপাশ। মঞ্চে আসর জমিয়েছিল বাউলের দল। সুদূর আর্জেন্টিনা থেকে আসা এক পর্যটক অত্যন্ত খুশি হয়ে এই শিল্পের অবারিত তারিফ করেছিলেন-যা প্রত্যেকটি খবরের কাগজের শিরোনাম হয়। তিনি এও বলেছিলেন এরকম উদ্যোগ প্রত্যেকবার নেওয়া উচিত। নাহলে শিল্পীরা তাদের যোগ্য মান পাবেননা।কিন্তু সত্যিই কি তারা উপযুক্ত সম্মান পাচ্ছেন? বিভিন্ন এনজিও বা এনপিও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের লোকশিল্পীদের নিয়ে কাজ করছে বলে শোনা যায়। তবে চড়িদায় তাঁদের কেউই কোনওদিন সেভাবে পৌঁছননি।
পৌঁছলেও সাতদিনের ওয়ার্কশপ ছাড়া আর কিছুই হয়নি। বড় সংস্থা বা এখনকার স্টার্ট আপ তো দূর অস্ত, সরকারি কোনও সাহায্যও এখানকার শিল্পীরা পান না।কয়েক প্রজন্ম ধরে চলতে থাকা এই কাজ এখনকার প্রজন্ম করতে চায় না। প্রত্যেকেই চান তাঁদের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনো করে ছোট হলেও যেন কোনও একটা চাকরি জোগাড় করতে পারেন।এই অবস্থায় আর কতদিন এগোতে পারবেন এখানকার শিল্পীরা? এই গ্রামের প্রত্যেকের চোখেমুখে হতাশার ছবিটা স্পষ্ট। একসময় ছৌ নাচের জন্য পদ্মশ্রী সম্মান পেয়েছিলেন পুরুলিয়ার গম্ভীর সিং মুড়া।কিন্তু শেষ বয়সে অর্থাভাবে, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছিল তাঁর।
এই সত্য অস্বীকার করা যাবে না যে পৃথিবীতে সব সৃষ্টি, সব ভালোরই, একটা শেষ, একটা চরম পরিণতি অপেক্ষা করে থাকে।তবে এক্ষেত্রেও কি এই মহার্ঘ্য সৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে কোনো দুঃখজনক নিয়তি? সেই আশঙ্কাই এখন তাড়া করে বেড়াচ্ছে চড়িদার ছৌ-মুখোশ শিল্পীদের।তবে দায় সকলের - কীভাবে এই শিল্পের সত্যতা কে চিরন্তন রাখা যায়!