জলদুর্গ দিয়ে বঙ্গ থেকে সোজা ঢাকা!

প্রাচীন ভারতীয় রাজনীতি ও কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের ইতিবৃত্ত ঘাঁটলে জানা যায় কৌটিল্যের রাজনৈতিক সাফল্যের ৭টি সূত্রের অন্যতম সূত্র ছিল রাজ্যের নিরাপত্তা সুপ্রতিষ্ঠিত করা। যার অন্যতম নিদর্শন মগধ। পরাক্রমশালী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে সে তার রাজধানী পাটলিপুত্র গড়ে তোলে, যা ছিল পর্বত ও অরণ্য পরিবৃত গঙ্গা, গণ্ডকী আর শোন নদীর সংগমস্থলে এক জলদুর্গ। পরবর্তীকালে অজাতশত্রু, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশোক, সমুদ্রগুপ্ত, ধর্মপালের মতো সম্রাটদের রাজধানী ছিল এই শহর।

            এ তো গেলো প্রাচীন ও আদি মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক দূরদর্শিতার প্রকাশ। এবার আসি মধ্যযুগীয় ব্যবস্থায়। যেখানে দেখা যায় সময়ের পরিবর্তনে চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটলেও কৌটিল্যের সূত্রের পরিবর্তন ঘটেনি। মুঘল আমলে ইছামতি আর মেঘনা নদীর সংগমস্থলে বানানো হল এক দুর্গ। আরও দুটো নদী বয়ে গেছে দুর্গের খুব কাছ দিয়ে। ধলেশ্বরী আর শীতলক্ষী। এতগুলো নদীর মাঝখানে দুর্গ তৈরি করার সামরিক গুরুত্ব যে অসীম, সেটা আর বলার অপেক্ষা থাকে না। এ ক্ষেত্রেও অবস্থানগত সুবিধেকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।

           এই আলোচ্য জলদুর্গকে কেন্দ্র করেও একটা শহর গড়ে উঠেছিল। পরবর্তী নাম মুন্সিগঞ্জ। অবশ্য যখন দুর্গ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তখন সেখানে ছিল ইদ্রাকপুর গ্রাম। সেই জায়গা থেকে দুর্গটিও পরিচিত হয়ে ওঠে ইদ্রাকপুর কেল্লা নামে। তখন বাংলার সুবাদার ছিলেন মিরজুমলা। ঢাকা থেকে তিনি বাংলা শাসন করতেন। কেল্লা গড়ে ওঠার পিছনে অন্যতম কারণ হলো এই সময় মগ আর পর্তুগিজ জলদস্যুদের ক্রমবর্ধমান প্রাদুর্ভাব। নদীপথে যখন তখন এসে তারা লুঠপাট চালাত, পালিয়ে যেত ঝড়ের বেগে। এইসব দুর্ধর্ষ জলদস্যুদের হাত থেকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ সহ আশেপাশের গোটা এলাকা নিরাপদ রাখতে ১৬৬০ সাল নাগাদ মিরজুমলা তৈরি করান এই ইদ্রাকপুর কেল্লা।  

          এবার আসি কেল্লার বর্ণনায়। কেল্লায় ঢুকতে গেলে মুঘল আমলে তৈরি একটা সেতু পেরোতে হয়। চারদিক উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। এই পাঁচিল খানিকটা শাপলা ফুলের পাঁপড়ির মতো দেখতে। কামান দাগার জন্য সব কটা পাঁপড়িতে ফুটো আছে। পাঁচিলের চার কোণে দেখা যায় চারটে আয়তাকার বুরুজ। পাঁচিলের পুব দেওয়ালের মাঝামাঝি অংশে রয়েছে বিশাল গোলাকার একটা উঁচু মঞ্চ। মঞ্চকে ঘিরে আরও একটা পাঁচিল দেখা যায়। দুর্গের উত্তর দিকে রয়েছে বিশাল প্রবেশদ্বার। সেখানকার সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়া যায় মূল দুর্গের চূড়াতে। মাটির নিচে একটা কুঠুরি আছে দুর্গের মধ্যে। ওই কুঠুরি ছিল অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদ মজুত রাখার গুদামঘর। একটা জনশ্রুতি আছে, সেই কুঠুরিতে নামার সিঁড়ি আসলে গোপন সুড়ঙ্গের অংশ, যে সুড়ঙ্গপথে ইদ্রাকপুর কেল্লার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ঢাকার লালবাগ দুর্গের। ইদ্রাকপুর কেল্লার বাসিন্দারা কোনো কারণে বিপদে পড়লে ওই সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢাকায় পালানোর ব্যবস্থা ছিল

যদিও এই দুর্গ এখন পরিত্যক্ত দুর্গ ছাড়া আর কিচ্ছু নয়। তবে যদি একবার সেই সময়কার কথা ভাবি, তাহলে সেই আমলের নবাবদের দূরদর্শিতার পরিচয় যথেষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়।সেই কারনে এই দুর্গের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে কিছুতেই অস্বীকার করার উপায় নেই।

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...