উস্তাদ আমীর খাঁ সাহেব তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, “ উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর আশি শতাংশ পেয়েছেন অন্নপূর্ণা, সত্তর শতাংশ আলী আকবর আর ৪০ শতাংশ রবিশঙ্কর।”
কিন্তু তিনি আদ্যন্ত অন্তরালের মানুষ। শেষ প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে দেখা গিয়েছিল পঞ্চাশের দশকে। মাত্র তিনটি মিউজিক রেকর্ডিং পাওয়া যায় তাঁর। বাকি সবটাই অধরা। অজানা।
সেই অন্নপূর্ণা দেবীর জীবন এবার পর্দায়। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের অন্যতম সেরা নক্ষত্রকে তথ্যচিত্রে উপস্থাপন করেছেন নির্মল চন্দ্র দান্ডিয়াল। সুরবাহার শিল্পী রওশন আরা বেগম, ওরফে অন্নপূর্ণা দেবীকে নিয়ে তৈরী ৬৯ মিনিটের ' গুরু মা ' নামের তথ্যচিত্রটিতে শিল্পী জীবনের নানা দিক উঠে এসেছে। মানুষ হিসেবে ঠিক কেমন ছিলেন 'বাবা' আলাউদ্দীনের মেয়ে।
১৯২৭ সালের ৭ অক্টোবর চৈতি পূর্ণিমা তিথিতে মধ্য প্রদেশের মাইহারে তাঁর জন্ম। পিতা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ হিন্দুস্তানি ক্লাসিক্যাল মিউজিকের মাইহার ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা এবং ভাই আলী আকবর খাঁ কিংবদন্তি সরোদ শিল্পী।
১৯৪১ সালে মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে বিয়ে করেন বিখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্করকে। বাবা বিখ্যাত সেতার মায়েস্ত্রো ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে মাইহারে সেতার শিখতে এসেছিলেন তিনি। ১৯৪২ সালের ৩০ মার্চ তাঁদের সংসারে জন্ম নেয় ছেলে শুভেন্দ্র শঙ্কর। ১৯৬২ সালে রবিশঙ্করের সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। তার আগে থেকেই অবশ্য জন সমক্ষে অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি।
বিচ্ছেদের পর আর কখনও সামনে আসেননি তিনি। বাইরের দুনিয়ার জটিলতা থেকে অনেক দূরে নিজস্ব পৃথিবীতে মগ্ন থেকেছেন। তবে সঙ্গীত থেকে দূরে যাননি। আকাশ গঙ্গার নিভৃতে সুরবাহারের সাধনায় নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। আমৃত্যু বজায় ছিল সেই ধারা।
মাইহার ঘরানার সঙ্গীতকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন শিষ্যদের মধ্যে। ওঁর সুপ্রতিষ্ঠিত শিষ্য তালিকায় রয়েছেন হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমুখ আরও অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পী।
অন্নপূর্ণা দেবী ছিলেন ভীষণ অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ। নিজস্ব পরিমণ্ডলে সাধনায় ডুবে থাকতেন। ঠিক কী কারণে সঙ্গীতের দুনিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন তা নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। ২০০০ সালে এক সাক্ষাৎকারে একবারই মাত্র মুখ খুলেছিলেন এ বিষয়ে। তিনি বলেন,
“পঞ্চাশ দশকে আমরা যখন একসঙ্গে বাজাতাম, তখন শ্রোতা এবং সমালোচকদের কাছ থেকে আমার বেশি প্রশংসা পাওয়াটা পন্ডিতজীর (রবিশঙ্কর) ভালো লাগত না। সেটার একটা বিরূপ প্রভাব আমাদের বিয়ের ওপরে পড়ত। যদিও উনি (রবিশঙ্কর) সরাসরি আমাকে অনুষ্ঠানে গিয়ে বাজাতে বারণ করেননি, কিন্তু তাঁর নানা আচরণের মধ্যে স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ পেত - আমি যে এই বেশি হাততালি পাচ্ছি, তাতে উনি বিরক্ত হতেন।
“ আমি অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ, সংসারই আমার কাছে বড় ছিল, তাই খ্যাতির বদলে বিয়েটাকেই বাঁচাতে চেয়েছিলাম।”
তবে তাঁকে ছবির পর্দায় দেখা গিয়েছিল। মাত্র দু’বার। আলাউদ্দিন খাঁ’র জীবন নিয়ে করা ফিল্মস ডিভিশনের ডকুমেন্টরি ‘বাবা’ তে। এছাড়া,সঙ্গীত নাটক একাদেমিকে একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি ছিল বাংলায়। তাঁর জীবনের বহু দিক উঠে এসেছিল তাতে।
২০১৮ সালে ৯১ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
নির্মল চন্দ্র দান্ডিয়াল বেগম আখতারের জীবনী নিয়েও তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন অতীতে। ' গুরু মা ' প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেন, ' অন্নপূর্ণা দেবীর সম্পর্কে যেটুকু জানা যায় তা মূলত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিল্পীর নিজস্ব জীবন, সঙ্গীতযাত্রার উপেক্ষিত থেকে গিয়েছে। '