আলপনা দেওয়া চলছে। সোজা লম্বা হেঁটে এলে যেমন পর পর গরুর পায়ের ছাপ পড়ে, তেমনই। সেই আলপনা সদর দরজা পেরিয়ে চলেছে গোয়ালের দিকে। আজ সেখানে গরুদের বরণ হবে। এই সদর দরজা থেকে গোয়াল অব্দি তাদের পায়ের ছাপের আলপনা বড় প্রতীকী। এর মধ্যে ধরা আছে আমাদের কৃষিভিত্তিক সমাজের আদিম ইতিহাস--বন্য জীবন থেকে গরুকে বরণ করে গৃহপালিত করে তোলার কাহিনি।
আমাদের কৃষিজীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে গরু ছিল অপরিহার্য। তাই বৈদিক যুগ থেকেই আমাদের কাছে গাভী ছিল সম্পদস্বরূপ। তাই তাদের বলা হত, ‘গোসম্পদ’। মহাভারতে দুর্যোধনেরা বিরাট রাজার গোশালা থেকে এই গোসম্পদই চুরি করতে গিয়েছিলেন, অজ্ঞাতবাসী পাণ্ডবদের বাধায় অবশ্য তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। শ্রীকৃষ্ণ গোপকূলেই মানুষ হয়েছেন, হাতে তুলে নিয়েছেন তাদের সেবার ভার। মহাভারতের যুগে গুরুর আশ্রমে বিদ্যাশিক্ষার সূচনায় আশ্রমের গো-সেবার মধ্য দিয়ে গুরুর আস্থা অর্জন করে শিক্ষাগ্রহণ করতে হত। আয়োধৌম্যের কাহিনিতে আমরা এর পরিচয় পাই। যজ্ঞে বা শুভ কাজে গো-দান খুবই গৌরবের কাজ বলে মনে করা হত।
এমনিতে গাড়ি টানা থেকে শুরু করে জমিতে লাঙল টানা, শস্যের মাড়াই পর্যন্ত সমস্ত কাজই বলদ দিয়ে করিয়ে নেওয়াটাই আমাদের কৃষিজীবনের অঙ্গ ছিল সেই সুপ্রাচীন কালের ঐতিহ্যে। তাছাড়া গাভীর দুধ আশ্রম ও গেরস্তের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তো ছিলই। ধীরে ধীরে এই নিত্যপ্রয়োজনীয় ও অত্যন্ত উপকারী এবং নিরীহ স্বভাবের প্রাণিটি আমাদের কাছে পূজনীয় হয়ে উঠেছিল। ‘গো-বন্দনা’-র এই ঐতিহ্য আমরা আর্য ঋষিদের কাছ থেকে পেলেও বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, পুরুলিয়ার হিন্দুসমাজের মধ্যে ‘বাঁধনা’ পরবের যে প্রকৃতি চোখে পড়ে তা কিন্তু আদিবাসী সংস্কৃতি ও আর্য ঐতিহ্যের মিলিত একটা রূপ। কারণ, এই অঞ্চলের হিন্দুসম্প্রদায় আদিবাসীদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে রয়েছেন দীর্ঘকাল ধরে। ফলে, এক ধরণের মিশ্রসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এই অঞ্চলে।
লৌকিক শব্দ ‘বাঁধনা’ এসেছে, ‘বন্দনা’ শব্দ থেকে। গরু-গাভীকে সমস্ত কাজ থেকে বিশ্রাম দিয়ে তাদের ‘বন্দনা’ করাটাই এ উৎসবের মূল কথা। এর মূলে আদিবাসী সমাজে একটি লোকশ্রুতিও আছে:
স্বর্গের কপিলা গো-কুলের প্রতিভূ। সে একদিন মহাদেবের কাছে গিয়ে নালিশ জানাল যে, মর্ত্যে মানুষেরা তার গো-জ্ঞাতিদের প্রতি খুব অনাচার করে, অত্যধিক পরিশ্রম করায় কিন্তু ভালো কিছু খেতে দেয় না, ভালোবাসে না, কৃতজ্ঞতাও স্বীকার করে না। তখন মহাদেব গোজাতিকে সম্মান জানাতে মানুষকে আদেশ দিলেন বাঁধনা পরব উদযাপন করার জন্য। সুতরাং, এটাই এই উৎসব শুরুর গল্প।
এদিন গরুদের ভালো করে স্নান করানো হয়। তারপর ক্ষুর এবং শিঙে সরষের (আগে মাখানো হত মহুল ফলের তেল) তেল মাখিয়ে উজ্জ্বল করে তোলা হয়। তারপর গরুর গায়ের রঙ সাদা হলে সারা গায়ে কোথাও লাল-হলুদ গেরিমাটি, কোথাও বা আলতা ও নীলের ছোপ দেওয়া হয়, ফুল এঁকে সাজিয়ে দেওয়া হয়। আর গরুর গায়ের রঙ লাল বা কালো হলে চালের গুঁড়ো বা খড়িমাটি জলে গুলে একইভাবে ছাপ দেওয়া হয়। আগে হুঁকোর কলকের মাথা রঙে চুবিয়ে ছাপ দেওয়া হত। এখন একটা ছোট্ট পেঁপে আড়াআড়ি কেটে তা দিয়ে গোল দাগ ও বুনো ফল রঙে চুবিয়ে সুন্দর সুন্দর নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। তারপর পায়ে হলুদ জল দিয়ে, গলায় গাঁদার মালা, ধানের শিষের মালা পরিয়ে গরুদের বরণ করা হয়। এসব করার পর তাদের খেতে দেওয়া হয় আস্কে, গুড় পিঠে এবং কাখরার মতো লোভনীয় পিঠে। এই অংশ অব্দি আদিবাসী-সংস্কৃতির সঙ্গে মিল আছে। গরমিল শুরু হয় যখন বরণকালে ও পুজোর সময় আওড়ানো হয় বিষ্ণুমন্ত্র, তখন। কেবল এটুকু অবদান রেখেছে আমাদের আর্যসংস্কৃতি।
কালী পুজোর পর প্রতিপদের দিন এই পরব অনুষ্ঠিত হয়। তবে বাঁধনা পরবের যে সমারোহ দেখা যায় আদিবাসীদের মধ্যে, ততটা দেখা যায় না হিন্দুদের মধ্যে। আদিবাসীরা এই পরব তিনদিন ধরে পালন করেন, কিন্তু হিন্দুরা পালন করেন শুধু আজকের দিনটিই। আদিবাসীদের পরব অনেক বৈচিত্র্যময়। তাতে আছে ধামসা-মাদল সহযোগে গো-জাগরণের গান, বন্দনার জন্য অহিরা গান, খুঁটি পুজো এবং গরু বাঁধার দড়ি পুজো। এবং, তাঁদের উৎসব শেষ হয় গরুখুঁটা দিয়ে।
ছবি : পার্থসারথি পাণ্ডা।