আটচল্লিশ বছরের জন্মদিনে একটা ক্যামেরা উপহার দিয়েছিল মেয়ে। তা দিয়ে স্বামী চার্লস একটা ছবি তুলেছিলেন তাঁর। সেই ছবি মোড় ঘুরিয়ে দেয় পুরো জীবনের। বারো সন্তানের জননীকে আঁকড়ে ধরে ছবির নেশা। আর উনিশ শতক পেয়ে যায় সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলোকচিত্রীকে। শুধু উনিশ শতক নয়, তিনি একাই বদলে দিয়েছিলেন গোটা বিশ্বের ছবি প্রেমিদের ছবি দেখার চোখ। ছবি মানে শুধু মুখের প্রতিরূপ নয়, ছবি আসলে কবিতা। তার নিজস্ব ভাষা আছে। অনুভূতি আছে।
১৮১৫ সালে কলকাতায় অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারে জন্ম হয়। প্রথম নাম ছিল জুলিয়া মার্গারেট পেটল। বাবা জেমস পেটল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পদস্থ কর্মচারী। মা ফরাসি। অভিজাত পরিবারটিতে ইংরেজি, ফরাসি এবং হিন্দি ভাষায় অনর্গল কথা চলত।
ভার্জিনিয়া উলফ তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন,‘নিঃসন্দেহে তিনি প্রতিভাবান’।
এই প্রতিভা আড়ালে থাকেনি। নজরে পড়ে যান ক্যালকাটা ল’ কমিশনের এক সদস্যের। মিস্টার চার্লস হে ক্যামারুন। দেখা হয়েছিল দক্ষিন আফ্রকায়। চার্লস ভারতে লর্ড মেকলের সঙ্গে ভারতীয় দন্ডবিধির খসড়া তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন। এদেশে শিক্ষা ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল তাঁর। অসমবয়সী হলেও দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হতে সময় নেয়নি। সেই সম্পর্ক বিয়ের বন্ধনে বাঁধা পড়ে ১৯৩৮ সালে। ‘ মিস জুলিয়া মার্গারেট পেটল’ হলেন ‘মিসেস জুলিয়া মার্গারেট ক্যামারুন’।
ছয় সন্তান ছিল তাঁদের। দত্তক নিয়েছিলেন আরও ছয় সন্তানকে। ব্যক্তিগত জীবনে মায়ের হিসেবেও ভীষণ অন্যরকম। নিজস্ব দর্শন আর দেখার চোখ তাঁকে সব কিছুতেই অসাধারণ করে তুলেছিল।
১৮৬৩-তে চল্লিশ বছরের জন্মদিনে একটি ক্যামেরা উপহার পান। আর সেই উপহারই রাতারাতি বদলে দেয় তাঁর জীবন। মুক্তি খুঁজে পেয়েছিলেন স্টুডিয়ো আর ডার্ক রুমে। যত মুখ, তত রকম অভিব্যক্তি, তত রকম জীবন। মুহূর্তের গল্প খুঁজে চলা। সারা দিন কেটে যেত ছবির সঙ্গে।
তিনি নিজে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘ আমি শুরু করেছিলাম যখন তখন ‘আর্ট’ সম্পর্কে কোনও ধারনাই ছিল না’।
শুরু থেকেই তিনি পোট্রেট ফটোগ্রাফিতে মন দিয়েছিলেন। উনিশ শতকের বহু গুণী মানুষকে ফ্রেমবন্দি করেছিলেন তিনি। কোনও ফ্রেমই শুধুমাত্র ফ্রেম নয়। ছবির মানুষটিকে অন্য চোখে চিনতে শেখায়। তার মনমেজাজ, চরিত্র সবটা যেন আন্দাজ করা যায়। শুধু মাত্র বিখ্যাত মানুষ নয়, পরিবারের সদস্য, বাড়ির কর্মচারী, পরিচারক-পরিচারিকা সকলকেই ধরেছেন ক্যামেরায়। তা যেন কখন সমাজের ছবি হয়ে উঠেছে। উনিশ শতককে অনুভব করা যায় ।
অ্যালফ্রেড লর্ড টেনিসন, হেনরি ওয়ার্ডসওয়ার্থ লংফেলো, মহাকাশচারী স্যার জন হ্যাশেল, টমাস কার্লেইল, চার্লস ডারউইনের মতো মানুষদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন জুলিয়া। তাঁর স্টুডিয়োয় ক্যামেরার সামনে সিটিং দিয়েছেন এইসব মানুষরা। তবে জুলিয়া ভালবাসতেন মেয়েদের বিভিন্ন অনুভূতিকে ক্যামেরায় ধরতে। অভিনেত্রী এলিন টেরি, জুলিয়া জ্যাকসনের পোট্রেট প্রবাদ হয়ে আছে আলোকচিত্রের দুনিয়ায়। জুলিয়া জ্যাকসন জুলিয়া মার্গারেট ক্যামারুনের ভাইঝি। তাঁর অন্য পরিচয় তিনি বিখ্যাত লেখিকা ভার্জিনিয়া উলফের মা।
লর্ড টেনিসন তাঁর ‘ইডেল অফ দ্য কিং’ বইয়ের অলংকরনের ভার দিয়েছিলেন তাঁকে। তাঁর ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল।
জুলিয়ার আলোকচিত্রে শিল্পী জর্জ ফ্রেডরিক ওয়াট এর প্রভাব ছিল স্পষ্ট। তিনিই জুলিয়ার বন্ধু এবং শিক্ষক। দু’দশক ধরে তাঁর ছত্রছায়াতেই লালিত হয়েছিল উনিশ শতাব্দীর অন্যতম প্রতিভাধর ফটোগ্রাফারের। সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছিলেন তাঁর কাছেই।
১১ বছরের ছবি-জীবনে জুলিয়া বদলে দিয়েছিলেন ছবির ভাষা। এক সময় ছবির টেকনিক্যাল দিক নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু ‘এক্সপ্রেশন’- এর সূক্ষতার জন্য সেই সব ছবিই পরবর্তী সময়ে আলাদা উচ্চতায় পৌঁছেছিল। যেখানে মুগ্ধতা ছাড়া আরও কোনও ভাষা আসেনা দর্শকের মনে।
ভিক্টোরিয় যুগের পুরুষ প্রধান সমাজে এক মহিলা ফটোগ্রাফারের পথ খুব সহজ ছিল না। তারওপর ভারি ক্যামেরা, সায়ানাইড এর মতো বিপদজনক কেমিক্যালের ব্যবহার, প্রতিদ্বন্দ্বী সময়। পারিবার ও বন্ধুদের সমর্থন থাকলেও তা জুলিয়ার লড়াই সহজ ছিল না। কিন্তু এই সব কিছুকে তিনি হারিয়ে ছিলেন ইতিবাচক মানসিকতার জোরে। ক্যামেরার প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা আর মমতা ছাড়া তাঁর দৃষ্টিতে আর কিছুই ধরা পড়েনি। ছবি নিয়ে বিভিন্ন রকম পরীক্ষা-নিরিক্ষা চালিয়ে গিয়েছেন। আলোকচিত্র আসলে শিল্পের আর একটি মাধ্যম। এবং তা স্বয়ংসম্পূর্ণ- এই কথাই বারবার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি আসলে ফটোগ্রাফি দুনিয়ার ‘সিক্রেট হিরোইন’।
প্রতিদিন নতুন মুখের খোঁজ পাওয়া তাঁর কাছে জীবনের অন্য মানে হয়ে উথেছুইল। এভাবেই সবচেয়ে ভাল থাকতেন। মুহূর্তের জন্ম, তা থেকে উঠে আসা আদলে যে নান্দনিক বোধ আছে আজীবন ধরে তারই সন্ধান করে গিয়েছেন জুলিয়া। ভার্জিনিয়া বারবার বলেছেন তাঁর কথা।
সৌন্দর্যের খোঁজ জীবনের শেষ পর্বেও বহমান ছিল। ১৮৭৯ সালের ২৬ জানুয়ারি অন্তিম শয্যাতেও দেখা বদলায়নি তাঁর। নিভে যাওয়ার মুহুর্তে শান্ত ঠোঁট বলে উঠেছিল ‘বিউটিফুল’!
এই এক শব্দ দিয়েই যেন বলে গিয়েছিলেন নিজের গোটা জীবনটা।