সাহিত্যানুরাগই যাঁর জীবনকে আলোকিত করেছে

১৯২৬ সাল। এক সপ্তাহের মধ্যে একটা বইয়ের প্রায় ৫০০০ কপি বিক্রি হয়ে গেল। সাহিত্যের ইতিহাসে এমনটা এই প্রথম। বইটির কাহিনী যাঁকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছিল, সেই 'সব্যসাচী' আর কোনো সাহিত্যের চরিত্র রইল না। প্রত্যেক বাঙালির হৃদয়ে পূজিত হতে লাগল এই কাল্পনিক চরিত্র। সঙ্গে সেই বই হয়ে উঠলো দেশের প্রতি ভালোবাসার উদ্দীপক। 'পথের দাবী'। দ্বিতীয় সংস্করণের পথে যাবার আগেই ইন্ডিয়ান পিনাল কোডের ১২৪এ ধারা অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকার বইটির প্রকাশনা বন্ধ করে দিল। বইটিকে আখ্যা দেওয়া হল 'রাষ্ট্রদ্রোহী'। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই নিষিদ্ধ বইয়ের প্রকাশ বন্ধকে সমর্থন করেছিলেন। এদিকে বইয়ের লেখক কিন্তু মনে মনে আনন্দিত হয়েছিলেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন "বাঙালি পাঠকদের অন্তরে দেশপ্রেমের ভাবনার যে বীজ সুপ্ত ছিল, আমার লেখায় তাহা যদি মহীরূহের আকার নেয় আমি বুঝিব আমার উদ্দেশ্য সফল"। এমনই দীপ্তিময় অন্তরালোকে আলোকিত মানুষ ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর মৃত্যুর এক বছর পরে নিষিদ্ধ ‘পথের দাবী’ পুন:প্রকাশিত হওয়ার অনুমতি পায়।

১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই সেপ্টেম্বর হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে প্রখ্যাত কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। ভাগলপুরের মামার বাড়িতে তাঁর কৈশোর ও যৌবনের বেশ কিছুটা সময় কাটে। প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সেখান থেকেই। ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্যের সঙ্গে যুঝতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর সংগ্রাম-সর্বস্ব জীবনপথের পাথেয় ছিল সাহিত্যচর্চা। তিনি নিজের সম্বন্ধে লিখেছিলেন "আমার শৈশব ও যৌবন ঘোর দারিদ্রের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। অর্থের অভাবে শিক্ষালাভের সৌভাগ্য ঘটেনি। পিতার নিকট থেকে অস্থির স্বভাব ও গভীর সাহিত্যানুরাগ ব্যতীত আমি উত্তরাধিকারসূত্রে আর কিছুই পাইনি। পিতৃদত্ত প্রথম গুণটি আমাকে ঘরছাড়া করেছিল"। ১৭ বছর বয়সে তিনি প্রথম গ্রন্থ লিখতে শুরু করেন। পিতার মৃত্যুর পর ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মদেশ যাত্রা করার আগে অর্থোপার্জনের জন্য কিছুদিন চাকরি করলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি বুঝতে পারেন, চাকরি জীবন তাঁর জন্য নয়। তাই সাহিত্যচর্চার মধ্যেই খুঁজে পেয়েছিলেন অন্তরের যশ।

সাহিত্য প্রদীপের মত। তার বিচ্ছুরিত আলোকে উদ্ভাসিত হয় সমাজ। সাহিত্যিকরা সেই প্রদীপের সলতের মত। তাঁদের সৃষ্টি দিয়ে সমাজকে আলোকিত করে রাখেন। শরৎচন্দ্রের সময়ে কুসংস্কার, গোঁড়ামি, অন্ধবিশ্বাস , মেয়েদের অসম জীবন-যাপন সমাজকে ঘুণপোকার মতো কুরে কুরে খাচ্ছিল। শরৎচন্দ্র তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে প্রতিবাদের দিশা খুঁজে দিয়েছিলেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে। গভীর জীবনবোধে পরিপূর্ণ তাঁর রচনাগুলি। শরৎ সাহিত্যে নারী চরিত্র বিশেষভাবে মর্যাদা পেয়েছে। ‘রামের সুমতি’ ,’বিন্দুর ছেলে', 'বড় দিদি’, ’মেজদিদি’, ’দেবদাস‘, এই সকল কাহিনী নারী মনের গতিপথের হদিশ দিয়েছে। তাঁদের দুঃখ-যন্ত্রণা, গ্লানিকে তিনি সাদা কালো অক্ষরের মাধ্যমে অঞ্জলি প্রদান করেছেন। তাঁর ‘নারীর মূল্য ‘ প্রবন্ধে তৎকালীন সমাজে নারীদের বঞ্চনা ও লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। সমাজ ব্যবস্থার প্রতি কটাক্ষ করেছিলেন তাঁর সৃষ্টির ছত্রে ছত্রে।

রেঙ্গুনে থাকাকালীন শান্তি দেবীকে বিয়ে করেছিলেন শরৎচন্দ্র। তবে জীবন তাকে অভিজ্ঞতায়, বোধে, কষাঘাতে পূর্ণ করেছিল। তাঁর স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানকে কেড়ে নিয়েছিল প্লেগের মহামারী। সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে ১৯১৬ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই জীবনবোধে নিজেকে পরিপূর্ণ করেন। পরে মোক্ষদা নামের এক বিধবাকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। তাঁকে পড়াশোনা শিখিয়েছিলেন। জীবনের সঙ্গে সাহিত্যের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন এভাবেই। কলকাতায় ফিরে নিজের বোনের নামে অর্থাৎ অনিলা দেবী ছদ্মনামে লিখতে শুরু করেন। শরৎচন্দ্রের প্রথম মুদ্রিত রচনা 'মন্দির' নামে গল্পটি বাংলা ১৩০৯ সালে 'কুন্তলীন' পুরস্কার পায়। কলকাতায় ফিরে তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি যেন পূর্ণতা পায় জীবনের আঘাত থেকে। জীবনবোধের অন্তঃপুরে বিরাজমান মানুষটি ১৯৩৮ সালের ১৬ই জানুয়ারি চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। তবে তাঁর সাহিত্যের স্রোত আজও বহমান সমাজের অন্দরে।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...