সন্দেশখালি ব্লক ২। শীতলিয়া মৌজা। সুন্দরবন।
মৌজায় তিনশো পরিবার। ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সংখ্যা প্রায় ১৭০০।
উত্তাল নদীর ঢেউ সামলে সেখানে পৌঁছানো সহজ নয়। প্রতি মুহুর্তে মোচার খোলের মত দুলতে থাকে জলযানখানা। যাত্রীদের বুক ঢিপঢিপ। আকাশ ঘোর। ঘোলা বৃষ্টিতে পাড় দেখা যায় না।
রায়মঙ্গল পেরিয়ে ভটভটি পাড়ে এসে ঠেকলে শুধু কাদা আর মাটি। অনভ্যস্ত পা সাবধানে না ফেললেই এটেঁল মাটির হড়কান কাদা দাঁড়িয়ে থাকার অবকাশ দেবে না। ছিটকে পড়তেই হবে। পাড় বলে আদৌ কোনওদিন যে কিছু ছিল আন্দাজ করা দায়। জানা গেল পাড়ে নামার জন্য আগে ছোটখাটো ঘাটের ব্যবস্থা থাকলেও আম্ফানে ফুলে ওঠা নদীর রোষে তা ভেসে গিয়েছে।
আদিবাসী গ্রামের জলে ডোবা কাদামাটির পথে হাঁটতে গেলে পায়ের আঙুল আর নখ ভর করে থাবা দিয়ে পা ফেলে শিখতে হবে। পুরো পা রাখা যায় না। পায়ের তলা খড়কুটো পেয়ে গেলে তবু কিছু সুরাহা মেলে। তবে ওই কাদা-পথ দিয়েই তরতর করে হেঁটে যান ওঁরা।নির্ভয়ে। জল-জঙ্গল আর প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে বেঁচে থাকা
নিজস্ব নিয়মে। শহর থেকে খোঁজ নিতে আসা আনকোরা মানুষরা সে নিয়মের হদিশ পায় না। চলতে গিয়ে কেবলই বেকায়দায় পড়তে হয় তাদের।
কাদা জল পার হয়ে গ্রামে ঢুকে পড়লে যেদিকে চোখ কেবল জল আর জল। নাহ, নদী নয়। জোত-জমি এভাবেই ভেসে গিয়েছে। জল নামেনি এখনো। নোনা জলে ডুবে যাওয়া জমিতে নোনা ভাব বেড়ে গিয়েছে। আবার কবে চাষ শুরু করা যাবে বা আদৌ চাষ সম্ভব কিনা সে নিয়ে আন্দাজ নেই। পুকুর-দিঘিরও একই অবস্থা।
সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই গ্রাম থেকে হারিয়ে গিয়েছে ‘রান্নাঘর’ শব্দটাই। প্রতিদিন দুপুর নামলে ঘরহীন মানুষরা দাঁড়িয়ে থাকেন গ্রামের কমিউনিটি কিচেনের লাইনে। সেখান থেকে কখনও ভাত, কখনও খিচুড়ি যা পাওয়া যায় তাই দিয়েই দিন-গুজরান। একবেলার খাবার দু-বেলা চালিয়ে জীবন চলে। হারিয়ে গিয়েছে ‘স্বাভাবিক’ শব্দটাই।
নদী দিয়ে বয়ে আসা ভটভটই এই মুহুর্তের বিপদতারণ। দিনের আলো যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ বেঁচে থাকার স্পর্শ। সন্ধে নামলে খোলা আকশের নীচে রাত। সাপ-বাঘ এমনকি ভয় মানুষেরও। ছাদহারা মানুষ রিলিফ ক্যাম্পের সামনে দাঁড়ান একটুকরো ছাদের আশায়। পলিথিন শিট দিয়ে মাথা ঢাকা। তাও অপ্রতুল।কেউ পায়, কেউ পায়না। ক্ষোভগুলো মিশে যায় ভাটির জলে। একে অপরকে আশা বাঁচিয়ে রাখার প্রবোধ দেয়। যে ছেলেটার আসছে পুজোয় নতুন সাইকেল কেনার কথা ছিল শহর থেকে আসা শুকনো মুড়ি আর বিস্কুট হাতে পেয়েও ঝলমল করে ওঠে চোখ।
রাক্ষুসে আমফান ঘর-বার, জীবন সব নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু নিয়ে যেতে পারেনি প্রাণপন জুঝে যাওয়ার লড়াইটা। বনভূমে জান-মান টিকিয়ে রাখতে গিয়ে যা রক্তে মিশে গিয়েছে ওদের। সেই রসদেই প্রতিদিন ঘুরে দাঁড়াবার জেদ বাঁচিয়ে রাখেন ওরা। আজ নাহোক কাল ঘুরে দাঁড়াবেনই।