'আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জি’
তাঁর মেঘ মন্দ্রিত কণ্ঠের অনুরণনে উৎসব আসে বাঙালির ঘরে। মহালয়া তিথির ঊষায় আকাশে বাতাসে বেজে ওঠে দৈবস্বর।
গলার মায়া ভুলিয়ে দেয় রোজকার জীবনের ক্ষতগুলোকে, এমনই তার প্রভাব। ইথার তরঙ্গে ধ্বনিত হয়ে ফেরা কণ্ঠের মানুষটি বাঙালির জন্মদাগ। বছর বছর তাঁর কাছেই ফিরে আসা। বেতার দুনিয়ার অধীশ্বর। গত ৯০ বছর ধরে রাজমুকুটটি তাঁর শিরেই। তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। রেডিয়োর ‘ভদ্রমশাই’।
যে কণ্ঠের ঘোরে মুগ্ধ থেকেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই কণ্ঠকেই একদিন বাতিল হতে হয়েছিল রেডিয়োয় প্রথম অডিশনে। পরে মিলেছিল ডাক।
সরকারী চাকরী ছেড়ে এসে যোগ দিয়েছিলেন বেতারে। রেলে চাকরি করতেন। ছেড়েছিলেন নিজের মনের মতো কাজ করবেন বলে। কলকাতা বেতারে যোগ দেওয়ার পর ভারতীয় অনুষ্ঠানের ডিরেকটর নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদারের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। সাহিত্য আর নাটক বিভাগের দেখভাল। আসলে নামেই। রেডিয়ো স্টেশনে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই সামলাতেন। কখনো নাট্য প্রযোজক, কখনো অভিনেতা, কখনও আবৃত্তিকার।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণের জন্ম আহিরীটোলায়, মামাবাড়িতে। ডাকনাম ‘বুশি’। খুব ছোটবেলায় চলে আসেন শ্যামপুকুরের রামধন মিত্র লেনে। বাড়িটি কিনেছিলেন তাঁর ঠাকুমা। তাঁর কাছেই ছোটবেলায় সংস্কৃত আর শেক্সপিয়রের পাঠ নিতেন।
বেতারে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রযোজনায় স্তোত্রপাঠের ভার যখন তাঁকে দেওয়া হয় আপত্তি এসেছিল বহু। কায়স্থের সন্তান চণ্ডীপাঠ করবে, এই সমাচারে তীব্র ক্ষোভ গোঁড়া ব্রাহ্মণ সমাজে। কিন্তু সেসবের তোয়াক্কা করেননি পঙ্কজ মল্লিক আর বাণীকুমার ভট্টাচার্য।
পরণে গরদবস্ত্র। কপালে চন্দন। ভোর রাতে স্নান সেরে চণ্ডীপাঠ শুরু করতেন শ্যামপুকুরের ছোট্টখাট্টো গৌরবর্ণ মানুষটি।
বয়স যখন আট বছর তখন থেকে চণ্ডীপাঠের শুরু।। মাস্টারমশাই রাজেন্দ্র নাথ দের ইচ্ছেতে বেলুড়মঠ যেতেন মঠের সন্ন্যাসীদের আবৃত্তি শোনাতে। ওই সময়েই জীবনে প্রথমবার চন্ডী পাঠ। মাস্টার মশাইয়ের বাড়ির দুর্গাপুজোয়। ছোটবেলার অভিজ্ঞতাই কাজ দিয়েছিল বেতারে।
পাঠ করতে করতে তন্ময় হয়ে যেতেন। গলা জড়িয়ে আসত কান্নায়। সেই আকুলতা ছুঁয়ে যেত বাকিদের। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ নিজেও কাঁদতেন, শ্রোতাদেরও কাঁদাতেন। সত্যি সত্যি দেবী নেমে আসতেন ধরার মাটিতে।
অশুভকে নাশ করে প্রসন্ন আলোয় ভরে দিতেন ধরা। শরতের আনন্দ কিরণে ম্লান হয়ে যেত সব বিতর্ক। সব অসূয়া।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ জায়গা আর কাউকে দেয়নি বাঙালি। দিনে দিনে মিথ হয়ে উঠেছে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। সেই মিথের কাছে পরাস্ত হতে হয় উত্তম কুমারকেও।
সময়টা উত্তাল সত্তর। ১৯৭৬। জরুরী অবস্থা চলছে। বেতার কর্তৃপক্ষ ঠিক করে সেবার নতুন কিছু করার। নতুন মুখ, গ্ল্যামরের ছটায় হুহু করে বাড়বে শ্রোতার সংখ্যা। নির্ধারিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটি বাতিল করে নতুন প্রযোজনা। নতুন অনুষ্ঠানটির নাম ‘দেবীদুর্গতিহারিণীম্’। গ্রন্থনায় ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তী। সঙ্গীতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গান লিখেছিলেন শ্যামল গুপ্ত। ভাষ্যপাঠে উত্তমকুমার। ছিলেন লতা মঙ্গেশকর,বসন্ত চৌধুরী। স্তোত্র পাঠে তৎকালীন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের বিভাগীয় প্রধান ডঃ গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায় এবং সেই সময়কার স্তোত্র গায়িকা মাধুরী মুখোপাধ্যায়।
‘দেবীদুর্গতিহারিণীম্’ বেতারে সম্প্রচার হতেই ক্ষেপে উঠেছিল বাঙালি। ভদ্র বাড়ির টেলিফোন বেজে গিয়েছিল একটানা। শ্রোতাদের ক্ষোভ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়েছিল নিরাপত্তারক্ষীদের। বাঙালি তাদের প্রিয় মহানায়কের বাড়িতে ঢিল ফেলতেও পিছপা হয়নি। গোটা অনুষ্ঠানই ডাহা ফ্লপ! এইভাবে মহিষাসুরমর্দিনীকে সরিয়ে দেওয়া মেনে নিতে পারেননি পঙ্কজকুমার মল্লিক। আঘাত পেয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র।
তবে মানুষ যে এমন প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে ভাবতেও পারেনি কেউ। নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে আক্ষেপ করতে হয়েছিল ময়রা স্ট্রিটের অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়কে। বীরুপাক্ষের বাড়িতে এসে ক্ষমা চেয়ে গিয়েছিলেন। জনরোষের কাছে নতিস্বীকার করতে হয়েছিল বেতার কর্তৃপক্ষকে। সসম্মানে ফেরাতে হয়েছিল বীরেন্দ্রকে।
তারপর কেটে গিয়েছে নব্বইটা বছর। শ্যামপুকুরের সেই মানুষটি আজও স্বমহিমায় বিরাজ করছেন বাঙালির অন্তরে। আজও তাঁর টানেই মহালয়ার ভোরে ব্রাহ্ম মুহুর্তে জেগে ওঠে বাঙালি। শুরু হয় উৎসব।
'আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জি, ধরনীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত; জ্যোতির্ময়ী জগতমাতার আগমন বার্তা, আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি, অসীম ছন্দে বেজেউঠে, রূপলোক ও রসলোকে আনে নবভাবনা ধূলির সঞ্জীবন, তাই আনন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন, আজ চিচ্ছক্তি রূপিণী বিশ্বজননীর শারদশ্রী বিরন্ডিতা প্রতিমা, মন্দিরে মন্দিরে ধ্যানবোধিতা ...'