শরৎকুমারী দেবী

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নবম সন্তান ও তৃতীয়া কন্যা শরৎকুমারী দেবীর জন্ম ১৮৫৮ সালে জোড়াসাঁকোয়। শরৎকুমারীর দিদি সৌদামিনী দেবী তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছেন, “আমাদের বাল্যকালে মেয়েদের মধ্যে লেখাপড়ার চর্চা বড় একটা ছিল না।…. আমাদেরও প্রথম শিক্ষা একজন বৈষ্ণবীর নিকট হইতে।

তাঁহার কাছে শিশুপাঠ পড়িতাম, এবং কলাপাতে চিঠি লেখা অভ্যাস করিতাম”। এরপর প্রথমে এক বাঙালি খ্রিস্টান শিক্ষয়িত্রীর কাছে ও পরে “হপ্তায় একদিন মেম আসিয়া আমাদিগকে বাইবেল পড়াইয়া যাইতেন”। কয়েক মাস পর, মহর্ষি মেয়েদের পড়ার খোঁজ নিতে গিয়ে শিক্ষয়িত্রীর বানান ও ভাষা দেখে পড়া বন্ধ করে দিলেন। শুরু হল অযোধ্যানাথ পাকড়াশীর কাছে পড়ার পালা “বৌঠাকুরাণী তিনজন, মাতুলানী দিদি আর তাঁরা তিন বোন”- সকলের। এই তিন বোনের অন্যতমা ছিলেন শরৎকুমারী।

সেকালের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি বয়স পর্যন্ত অবিবাহিতা ছিলেন শরৎকুমারী। সৌদামিনী দেবী জানিয়েছেন, ‘‘আমার সেজ ও ন বোন অধিক বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত ছিল বলিয়া আত্মীয়েরা চারিদিক হইতে মাকে এবং পিতাকে তাড়না করিতেন। মা বিচলিত হইয়া উঠিতেন কিন্তু পিতা কাহারও কোনো কথা কানেই লইতেন না”। জোড়াসাঁকো ঠাকুরপরিবার পিরিলি ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্ম হওয়ায় বাড়ির ছেলেমেয়েদের বিবাহের জন্য পাত্র পাওয়া কঠিন ছিল।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিয়ের পর কন্যারা স্বামীসহ জোড়াসাঁকোতেই থাকতেন। শরৎকুমারী দেবীর স্বামী যদুনাথ মুখোপাধ্যায়ও জোড়াসাঁকোতে থাকতেন। তাঁর দাদা নীলকমল মুখোপাধ্যায়ের বিয়ে হয়েছিল ৫ নম্বর জোড়াসাঁকো বাড়িতে। যে কারণে ছোট থেকে যদুনাথ ৬ নম্বর জোড়াসাঁকো বাড়িতে অবাধে যাতায়াত করতেন।

ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী বলেছেন, “সেই নজিরে বিয়ে হবার পরেও সেজোপিসিমা তাঁকে ‘যদু ও যদুʼ বলে ডাকছেন শুনে কর্তাদিদিমা নাকি মেয়েকে ধমক দিয়েছিলেন– “যদু যদু কীরে?- যদু কি তোর ফুলবাগানের মালী”? পারিবারিক জীবনে স্নেহশীল যদুনাথ বিলেত থেকে ফিরে এসে বাড়ির ছোটদের খাওয়াতেন এক মজার খাওয়া-বাসি কড়কড়ে লুচির সঙ্গে দুধের সর ও খেজুরের গুড় চটকে পাকানো গোলা।

সুরসিক যদুনাথ মুখোপাধ্যায়ের একটা জবাব একেবারে চিরস্মরণীয়। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির এক প্রতিবেশী তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন যে ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েরা এত সুন্দর হয় কীভাবে? তাঁর সংক্ষিপ্ত উত্তর ‘দুধে আর মদে’। দক্ষ অভিনেতা ছিলেন যদুনাথ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘‘আমার ভগিনীপতি ৺যদুনাথও একজন ভাল হাস্যরসিক অভিনেতা… ছিলেন– তিনিও উপস্থিতমত মনগড়া অনেক কথা বলিয়া, দর্শকদিগকে হাসাইতে পারিতেন’ʼ। রঙ্গরসে ভরা সেজ মেসোমশাই- এর উল্লেখ করেছেন সরলা দেবীও।

শরৎকুমারী কখনও অভিনয় করেছেন বলে জানা যায়নি। তাঁর আগ্রহ ছিল রূপচর্চায়। প্রসঙ্গত ইন্দিরা দেবীর বক্তব্য এই রকম, “আমাদের সেজ পিসিমা শরৎকুমারীর সম্পর্কে এইটুকুই বিশেষ করে মনে পড়ে যে, তিনি পারিবারিক রূপসাধনার একটি একনিষ্ঠ সাধিকা ছিলেন।

জোড়াসাঁকোর বাড়ির ভিতরের একটা মহলের একতলায় যে সাধারণ স্নানাগার ছিল ( মোগল বেগমদের হামামের সঙ্গে তুলনীয় না হলেও তাতে বেশ মাঝারি সাইজের একটি চৌবাচ্চা ছিল ) সেখানে ঢুকতেই একটি ছোট বাঁধানো বেঞ্চিতে বসে সেজ পিসিমা নিজের প্রসাধনে রত থাকতেন, তা সে যে প্রথমে যেত সেও দেখত আর যে শেষ স্নান করে বেরত সেও দেখত– তখনও তিনি সেখানে বসে ঘষামাজা করছেন”।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে সকালবেলায় ভাঁড়ার ঘরের এক বৈঠক বসত বলে জানিয়েছেন সরলা দেবী- “এই তরকারী কোটার আসরে বড় মাসিমা, সেজ মাসিমা (শরৎকুমারী) ও ছোট মাসিমা, বড় মামী, নতুন মামী ও ন মামী এবং সরোজা দিদি ও সুশীলা দিদি- এই কজনের নিত্য উপস্থিতি দেখতে পেতুম”।

তিনি আরও জানিয়েছেন যে মহর্ষি জোড়াসাঁকোতে থাকলে “তাঁর জন্যে দুটি একটি বিশেষ রান্না শুক্ত ইত্যাদি মাসিদের হাতে এই ভাঁড়ার ঘরের বহিঃপ্রকোষ্ঠেই হত”। সে সব রান্নায় হাত লাগাতেন শরৎকুমারী দেবী। কেননা, রান্নায় তাঁর বিশেষ দক্ষতা ছিল- “সেজ মাসিমা প্রসিদ্ধ সুপাচিকা ছিলেন” বলেছেন সরলা দেবী।

পরবর্তী কালের প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর রান্নার দক্ষতা সর্বজনবিদিত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সেজ দিদি শরৎকুমারী দেবীও যে রন্ধনশিল্পী ছিলেন সেকথা ক’জন জানেন? ইন্দিরা দেবীর স্মৃতিকথায় আছে, ‘‘সেজ পিসিমা রান্নায় খুব দক্ষ ছিলেন। এমনকি পেঁয়াজের নির্গন্ধ পরমান্ন পর্যন্ত করতেন”। শরৎকুমারী ভাল বাসতেন গল্প করতে, তাস খেলতে।

সরলা দেবী জানিয়েছেন, ‘‘নিজেদের ঘরে এসে খেয়েই যে তৎক্ষণাৎ ঘুমুতে যেতুম সব সময় তা নয়। সেজ মাসিমাদের ‘দশ- পঁচিশ’ ও ‘তাসের আড্ডা’ জমত ঐ সময়”। শুধু রাতে শোবার আগে তাস খেলা নয়, স্বর্ণকুমারী দেবী যখন সপরিবারে সিমলা পাড়ার বাড়িতে থাকতেন তখন তাঁর শোবার ঘরের প্রকান্ড পালঙ্কে জোড়াসাঁকো বাড়ি থেকে আসা মাসি, মামী ও দিদিদের প্রায় নিত্যই গড়ান পার্টি জমত বলে জানিয়েছেন সরলা দেবী।

দুই পুত্র ও চার কন্যার জননী শরৎকুমারীর দুই পুত্রেরই অল্পবয়সে মৃত্যু হয়। কন্যাদের জ্যেষ্ঠা সুশীলা দেবী ‘বাল্মীকিপ্রতিভা’য় লক্ষ্মীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। দ্বিতীয়া কন্যা সুপ্রভাও কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন। সুপ্রভার পুত্র পরবর্তী কালের প্রখ্যাত শিল্পী অসিত হালদার।

জোড়াসাঁকোর সুবৃহৎ পরিবারে নানা গুণে গুণী ভাইবোনদের মধ্যে শরৎকুমারীর নিজস্বতা তেমনভাবে চোখে পড়েনি। রন্ধনপটিয়সী, তাস খেলা, গল্পে আড্ডায় দিন কাটানো শরৎকুমারী দাদা বীরেন্দ্রনাথের জন্য বধূ পছন্দও করেছিলেন। প্রফুল্লময়ী দেবীর স্মৃতিকথায় ধরা আছে সে কাহিনী। এভাবে সহজ হাসি আনন্দে দিন কাটাতে ভাল বাসতেন শরৎকুমারী।

নিজের রন্ধননৈপুণ্য বিষয়েও তিনি খুব সচেতন ছিলেন বলে মনেহয় না। নিজের কথা তিনি কোথাও বলেননি, কখনও লেখেন নি কিছু। ‘দুঃখ সুখ আপনারইʼ করেই জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর রন্ধননৈপুণ্য ও রয়ে গেল সকলের অগোচরে, কয়েকজনের স্মৃতিতে। এভাবেই কেটে গেল দিন। ১৯২০ সালে জীবনান্ত হল শরৎকুমারী দেবীর।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...