বিমল মিত্র: জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠা এক সাহিত্যিকের নাম

"ভেজাল" - এই শব্দটা আমরা  সবাই বহুবার বহুক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে শুনেছি। ভেজাল সর্ষের তেল, ভেজাল ঘি, ভেজাল ওষুধ এমন কি দুধে বা ছানাতে ভেজাল দেওয়ার কথাও আমরা মাঝেমধ্যেই শুনে থাকি। কিন্তু ভেজাল লেখকের কথা শুনেছেন কখনো? অবাক হচ্ছেন? কিন্তু এমন ঘটনাই ঘটেছিল এই বঙ্গভূমিতেই। তাহলে শুনুন সেই কথা।

দেশ পত্রিকায় তখন প্রকাশিত হয়েছে এক বিখ্যাত উপন্যাস... হ্যাঁ, সেই সাহিত্যিকেরই রচনা। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তখন তিনি। সেই সময় আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহর থেকে এক ভদ্রলোক তাঁকে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন যে তাঁর কয়েকটি উপন্যাস একেবারেই অপাঠ্য বা ট্র্যাশ। অথচ উপন্যাসগুলির নাম পড়ে সেই সাহিত্যিক চূড়ান্ত বিস্মিত, কারণ ঐ নামের উপন্যাসগুলো তিনি লেখেনই নি। খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছানোর মাশুল দেওয়া এই  সাহিত্যিকের নাম বিমল মিত্র...শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পর এই বাংলায় এত জনপ্রিয়তা সম্ভবত আর কোনো সাহিত্যিক অর্জন করতে পারেননি।

বিমল মিত্র এতটাই জনপ্রিয় লেখক ছিলেন যে বেশ কয়েকজন নকল বিমল মিত্রও সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে গল্প বা উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিল। এই কারণে আসল বিমল মিত্রের বহু ক্ষতিও হয়েছিল। কারণ বাজারে বিমল মিত্রের নামে অত্যন্ত নিম্ন মানের বেশ কিছু বই ছেয়ে গিয়েছিল। এবং এই কারণে শুধু দেশে নয়, বিদেশ থেকেও নিন্দা শুনতে হয়েছিল তাঁকে যে প্রসঙ্গ উপরেই উল্লেখ করা হয়েছে। এক নকল 'বিমল মিত্রের' বিরুদ্ধে তিনি আদালতে মামলা পর্যন্ত করেছিলেন কিন্তু সেই মামলায় তিনি হেরে গিয়েছিলেন কারণ একই নামে দুজন লেখক থাকতেই পারে। এমনই ছিল তাঁর জনপ্রিয়তা যে একজন নয় বেশ কয়েকজন নকল বিমল মিত্র গজিয়ে গিয়েছিল এবং এক শ্রেণীর অসাধু প্রকাশক এই নকল বিমল মিত্রদের বই ছাপিয়ে রাতারাতি ধনী হয়ে গিয়েছিল।

সাহিত্যিক বিমল মিত্রের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে আরো কয়েকটি ঘটনা জানানো যেতে পারে। এক সন্ধ্যায় বিমল মিত্রের কাছে ফোন এসেছিল সেই যুগের বিখ্যাত এক নায়িকার। সেই নায়িকা দেখা করতে এবং সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করার জন্য আসতে চেয়ে ছিলেন বিমল মিত্রের বাড়িতে কিন্তু তার নাম শুনেই বিমল মিত্র পত্রপাঠ তাকে বারণ করে দেন। সেই নায়িকার নাম ছিল সুচিত্রা সেন।

স্বয়ং উত্তম কুমার তার কাছে "কড়ি দিয়ে কিনলাম" উপন্যাসটি কিনতে চেয়েছিলেন সিনেমা তৈরি করার জন্য কিন্তু বিমল মিত্র সেটা দিতে রাজি হননি। কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন যে উত্তম কুমার যদি সেই উপন্যাসটি নিয়ে ছবি করেন তাহলে লোকে আর সেই উপন্যাস পড়বে না।

তার "কড়ি দিয়ে কিনলাম", "সাহেব বিবি গোলাম", "বেগম মেরী বিশ্বাস", "আসামি হাজির" এই উপন্যাসগুলির যে কতগুলো সংস্করণ বের হয়েছে তা গুনে হয়তো বলা যাবে না। "সাহেব বিবি গোলাম"-কে তাঁর সব থেকে বিখ্যাত উপন্যাস বলা যেতে পারে, যে উপন্যাস নিয়ে হিন্দি ভাষায় এক কালজয়ী ছবি তৈরি করেছিলেন বিখ্যাত অভিনেতা-পরিচালক গুরু দত্ত। উত্তম কুমারও "সাহেব বিবি গোলাম" (বাংলা) ছবিতে অভিনয় করেছিলেন।

তাঁর নামে অন্তত ২০০ টি বই বেরিয়েছিল যে বইগুলোর লেখক আদৌ তিনি নন। বাধ্য হয়ে তাঁকে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ঘোষণা করতে হয়েছিল যে একমাত্র "কড়ি দিয়ে কিনলাম" ছাড়া সব উপন্যাসে তাঁর নিজের সই আছে। এই উপন্যাসের জন্যই তিনি পেয়েছিলেন রবীন্দ্র পুরস্কার। "কড়ি দিয়ে কিনলাম" যখন ধারাবাহিক হিসেবে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছিল তখন বইয়ের স্টলে দাঁড়িয়ে মানুষ সেই উপন্যাস পড়ে নিত, এমনই ছিল এর জনপ্রিয়তা। তাঁর গল্প বা উপন্যাস ভারতের যতগুলি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল একমাত্র শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া আর কোনো লেখকেরই সৃষ্টি অতগুলি ভাষায় অনূদিত হয় নি।

নিজের সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন “...সত্যিই আমার কিছু হয়নি। অবশ্য তা নিয়ে আমি দুঃখও করি না। কারণ জীবনে যে কিছু হতেই হবে তারই বা কী মানে আছে। আকাশের আকাশ হওয়া কিংবা সমুদ্রের সমুদ্র হওয়াটাই তো যথেষ্ট। লেখক আমি হতে না-ই বা পারলাম, মূলত: আমি একজন মানুষ। মানুষ হওয়াটাই তো আমার কাছে যথেষ্ট ছিল।"

এই বিনয় এবং নিরহঙ্কার ভদ্রতা বোধই হয়তো তাকে বাংলার চিরদিনের জনপ্রিয়তম লেখকদের  একজন করে তুলেছিল।

 

 

 

 

 

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া এবং বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও প্রবন্ধ

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...