প্রফুল্লচন্দ্রের বয়স তখন সত্তর পার। চোখে দারুণ সমস্যা। দেখতে কষ্ট, পড়তে কষ্ট, আলোয় কষ্ট। দিনের বেলায় তাই বেশিরভাগ সময়ই চোখে পট্টি বেঁধে রাখেন। কিন্তু, মানুষটা যে অসম্ভব পড়তে ভালোবাসেন, তার কী হবে! জীবনে যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, সন্ধ্যেবেলায় ময়দানে হাওয়া খাওয়া এবং নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাসের রুটিন একদিনের জন্যও বেনিয়ম হয়নি তাঁর। এখনো হল না। এই সময় তিনি বই পড়ে শোনানোর জন্য একজন লোক রাখলেন। সকাল ছ'টা থেকে ন'টা এবং বিকেল তিনটে থেকে পাঁচটা...এই পাঁচ ঘণ্টার জন্য। প্রবন্ধ লেখার হলে, তিনি মুখে বলে যান, আর কলমচী লিখে যান। এই ব্যবস্থাই বহাল হল। কিন্তু, নিয়মের ব্যতিক্রম কিছুতেই হতে দিলেন না!
'প্রবাসী' ও 'মডার্ণ রিভিউ' পত্রিকার সম্পদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রফুল্লচন্দ্রের দারুণ সখ্যতা। এই দুই পত্রিকার তিনি একাধারে সমঝদার পাঠক এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক। রামানন্দ এই সময় শেক্সপিয়রের নাটক নিয়ে 'মডার্ণ রিভিউ'-তে কিছু লেখার জন্য প্রফুল্লকে অনুরোধ করলেন। এবং, প্রফুল্লও শিশুর মতো উৎফুল্ল হয়ে কথা দিয়ে বসলেন। তাঁর অধ্যয়নশীল মন, ছাত্রসুলভ অনুসন্ধিৎসা, গবেষকের নিষ্ঠা তাঁকে কোনদিন দায়সারা কাজে লিপ্ত করতে পারেনি। যা করেছেন সবের পিছনেই তিনি নিরলস শ্রম ও নিষ্ঠার দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। এক্ষেত্রেও তাই হল। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি, ইম্পিরিয়াল অর্থাৎ ন্যাশনাল লাইব্রেরি, এশিয়াটিক সোসাইটি এবং রামমোহন লাইব্রেরি থেকে দেশ-বিদেশের পণ্ডিতজন সম্পাদিত শেক্সপিয়ারের রচনাবলির বিভিন্ন সংস্করণ যেমন আনালেন; তেমনি আনালেন হাডসন ডাউডেন, ব্রাডলি প্রভৃতি পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের লেখা শেক্সপিয়র-সাহিত্যের গুচ্ছের সমালোচনা-পুস্তক। তাঁর পড়ার টেবিলে জমল বইয়ের পাহাড়। নিবিষ্ট মনে একে একে সে-সবের পাঠ শোনার পর 'জুলিয়াস সিজার', 'ওথেলো', 'ম্যাকবেথ', 'মার্চেন্ট অব ভেনিস'--প্রভৃতি নাটকের নানাদিক নিয়ে লিখলেন সুচিন্তিত, সুললিত এবং পণ্ডিত্যপূর্ণ একগুচ্ছ প্রবন্ধ। গুচ্ছে ছিল প্রায় তেরো থেকে চোদ্দটি প্রবন্ধ। সেগুলো ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হল 'মডার্ণ রিভিউ'-র বিভিন্ন সংখ্যায়।
প্রফুল্লচন্দ্রের শেক্সপিয়র-প্রীতি কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জন্ম-বছরেই তাঁর জন্ম; তাছাড়া মধুসূদনের জন্ম যে নদীর তীরে, সেই কপোতাক্ষর পাড়ে বাড়ুলি-কাটিপাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। সুতরাং, জন্মসাল এবং স্থানে একটা সাহিত্য-যোগ তাঁর ছিল। যাইহোক, ছোট থেকেই ইংরেজি সাহিত্য তাঁর প্রিয় বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল একটি। কৈশোরে কৃষ্ণবিহারী সেনের 'এলবার্ট স্কুল'-এ পড়ার সময়ই প্রিয় কবি মিল্টনের 'প্যারাডাইস লস্ট' ছিল তাঁর কণ্ঠস্থ। পরবর্তীতে অবশ্য প্রিয়-সাহিত্যিকের তালিকায় শীর্ষে এলেন শেক্সপিয়র। শেক্সপিয়রের সাহিত্য-বিষয়ে পণ্ডিত্য তাঁর তুল্য একমাত্র অধ্যাপক ললিত বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া আর কারও ছিল না সে-সময়। সেজন্য তিনি প্রায়ই বলতেন এবং ১৮২৩ সালের ১৮ নভেম্বর প্রিয় ছাত্র যোগেশচন্দ্র বাগলকে একটি চিঠিতে লেখেন যে: "I became a chemist by mistake."
সাধারণ মানুষ জানেন প্রফুল্লচন্দ্র রসায়নবিদ, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাব্রতী, স্বদেশি আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষক-নেতা-কর্মী, স্বদেশি প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা, বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা, বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধের লেখক; কিন্তু, তাঁরা জানেন না যে, 'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ' গঠনের উদ্যোক্তামন্ডলীর মধ্যেও তিনি ছিলেন, একদা এই পরিষদের সভাপতি ছিলেন, দীর্ঘদিন সহ-সভাপতি ছিলেন; তাঁরা জানেন না, তিনি কতবড় সাহিত্যরসিক ছিলেন! প্রফুল্লচন্দ্রের এই দিকটি নিয়ে সেভাবে আলোচনা হয়নি। আর তাই তাঁর শেক্সপিয়র-বীক্ষা সাময়িকপত্রের ধূসর পাতায় এখনো সহৃদয় পাঠকের অপেক্ষায়, পুস্তকের পুস্তুনিবন্দি হয়ে প্রকাশের সৌভাগ্য এখনও তার হয়নি...
তথ্যঋণ: প্রবন্ধ: প্রফুল্লচন্দ্র রায় - যোগেশচন্দ্র বাগল।