রবীন্দ্রবন্ধু ও দীনবন্ধু এন্ড্রুজ

"দুঃখের বরষায়

        চক্ষের জল যেই

                       নামল

বক্ষের দরজায়

         বন্ধুর রথ সেই

                     থামল..."

 

'গীতালি'র এই কবিতাটি রবীন্দ্রনাথের লেখাই হত না, যদি না দীনবন্ধু এন্ড্রুজ রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে আসতেন। আসলে আলাপচারিতা চলতে চলতে দীনবন্ধু ১৩২১ বঙ্গাব্দের এক শ্রাবণদিনে রবীন্দ্রনাথকে একটি গ্রিক কবিতা আবৃত্তি করে শোনালেন। সেই কবিতার ছন্দ-ঝংকার ছান্দসিক কবির মনে দোলা দিল। অমনি সঙ্গে সঙ্গে সেই ছন্দের আধারে 'দুঃখের বরষায়' লিখে ফেললেন কবি। তাই বলছিলাম যে, এন্ড্রুজ না-থাকলে কবিতাটি লেখাই হত না।

andrws

এন্ড্রুজ রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে প্রথম এলেন ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে কবির নোবেল প্রাপ্তির পূর্বে, ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী উইলিয়াম রোদেনস্টাইনের হ্যামস্টেডের বাড়িতে। তখন 'গীতাঞ্জলি'র কবিতাগুলোর ইংরেজি অনুবাদ হয়ে গেছে। বইটি ছাপা হয়নি। অনুবাদ পাঠ হবে। পাঠ করবেন আইরিশ কবি উইলিয়াম ইয়েটস। রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে সেই আবৃত্তি সাক্ষাৎ শুনবেন প্রখ্যাত সব মনীষীরা। কবি রবার্ট ব্রিজেস, সাংবাদিক হেনরি নেভিনশন, সাহিত্যিক এইচ জি ওয়েলস, কেমব্রিজ মিশনের ধর্মযাজক-অধ্যাপক-সাহিত্যিক চার্লস ফ্রিয়ার এন্ড্রুজ এবং পিয়ার্সন। 

আবৃত্তি শুনে উপস্থিত সকলেই অভিভূত। মোহিত হলেন এন্ড্রুজ। পেলেন অমৃতের স্বাদ। পেতে চাইলেন অমৃতদাতার অনন্ত সান্নিধ্য। গড়ে উঠল বন্ধুত্বের সেতু। বিলেতে থাকতে থাকতেই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শান্তিনিকেতন আশ্রমের অস্থায়ী শিক্ষক করে পাঠালেন।

এন্ড্রুজ ভারতবর্ষে এলেন। তবে এই প্রথমবার নয়। প্রথম বার এসেছিলেন ১৯০৪ সালে দিল্লিতে কেমব্রিজ মিশনের কলেজ, সেন্ট স্টিফেনস কলেজের অধ্যাপক হিসেবে। এসেই আলোড়ন তুললেন। কারণ, কলেজে অধ্যক্ষের পদ খালি হওয়ায় যোগ্য ব্যক্তি সুশীল রুদ্রকে বঞ্চিত করে তাঁকে অধ্যক্ষের পদ দেওয়ার চেষ্টা করলেন কর্তৃপক্ষ। সুশীল সুযোগ্য এবং খ্রিস্টান। কিন্তু, তাঁর অপরাধ তিনি ভারতীয় ও কালো চামড়ার মানুষ! 

ভেতরের কথাটি বুঝে এন্ড্রুজ চরম প্রতিবাদ জানালেন এবং সুশীলকে তাঁর যথাযোগ্য পদে আসীন করিয়ে তবেই শান্ত হলেন। কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিলেন তিনি নিছক ইংরেজ নন, নিছক খ্রিস্টান নন; তিনি প্রকৃত মানুষ এবং মানবিকতাই তাঁর ধর্ম।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ হয়ে উভয়ে উভয়ের মধ্যে সেই মানবিকধর্মকে আবিষ্কার করলেন। সেই ধর্মস্রোতেই সখ্যতা দৃঢ় হল। তাই কবিকে তিনি যতটা আপন করে বুঝলেন, অন্য কেউ তেমন করে বোঝেননি। একটা ঘটনার কথা বলি, তাহলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে :

নোবেল পাওয়ার পর কবি শান্তিনিকেতনে এলেন। কলকাতা থেকে অনুরাগী সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা জগদীশচন্দ্র বসুকে অগ্রবর্তী করে কবিকে সংবর্ধনা জানাতে এলেন। কিন্তু কবি তাঁর ভাষণে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে বসলেন যে, বিদেশে সম্মান পাওয়ার আগে তাঁকে স্বদেশের কেউ সম্মান দিতে আসেননি বা তাঁর লেখাকে সম্মানের যোগ্য বলে মনে করেননি। তাই এই সংবর্ধনা তিনি গ্রহণ করছেন বটে, কিন্তু অন্তরের সঙ্গে গ্রহণ করছেন না!

কথাটা শুনে উপস্থিত অনুরাগীরা ক্ষুব্ধ হলেন, অপমানিত বোধ করলেন। তাঁরা রবীন্দ্রনাথ আয়োজিত জলখাবার গ্রহন না-করেই চলে গেলেন। এই অভাবনীয় ঘটনায় রবীন্দ্রনাথ যখন অনুশোচনায় অস্থির, তখন বিষাদভার ভাগ করে নিতে তাঁর কাছে ছুটে এলেন একমাত্র এন্ড্রুজ।

তিনি রবীন্দ্রনাথের বাংলা-ভাষণের একবর্ণ না-বুঝেও পরিস্থিতি দেখে কবিগুরুর অন্তরের বিক্ষেপ বুঝতে পারলেন। সেই মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের কাছে এসে তাঁর চরণ-আশ্রয়ে স্থায়ীভাবে বাসের অনুমতি চাইলেন। তাতেই বুক জুড়িয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের। স্বদেশের অনুরাগীরা অভিমান করে দূরে চলে গেলেন, বিদেশের অনুরাগী নৈকট্য চাইছেন! রবীন্দ্রনাথ অভিভূত হলেন।  জড়িয়ে ধরলেন এন্ড্রুজকে।

দিল্লির অধ্যাপনা ত্যাগ করে শুধু রবীন্দ্রনাথের টানে  এন্ড্রুজ শান্তিনিকেতনে এসে যে তাঁর 'দ্বিতীয় ঘর' গড়ে তুললেন এমন নয়, ধুতি-পাজামা-পাঞ্জাবি পরিধান গ্রহণ করে, নমস্কার বিনিময়ের শিষ্টাচার গ্রহণ করে পুরো দস্তুর ভারতীয় তথা বাঙালি হয়ে উঠলেন। ভারতীয় ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা দেখে বেদজ্ঞ পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী তাঁকে 'ব্রাহ্মণ' বলে অভিহিত করলেন। এবং, তাঁর চরণ ছুঁয়ে প্রণাম করা শুরু করলেন।

নাটকের অভিনয়ের প্রতি দুর্বলতা এবং অসাধারণ পারদর্শিতা ছিল এন্ড্রুজের। সেক্সপিয়রের নাটক অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তিনি শান্তিনিকেতনে প্রথম 'ওপেন স্পেস' নাটকের প্রবর্তন করলেন। 

শান্তিনিকেতনে তিনি এসেছিলেন রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে থাকার আন্তরিক ইচ্ছে ছাড়াও আরো তিনটে ব্রত নিয়ে :

প্রথমত, ইংরেজি অনুবাদের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে রবীন্দ্র রচনার প্রসার ঘটানো; 

দ্বিতীয়ত, রবীন্দ্র আদর্শে শান্তিনিকেতন গড়ে তোলার কাজে প্রধান সহায়ক হওয়া; 

তৃতীয়ত, সারা ভারতের নিপীড়িত মানুষের জন্য কাজ করা।

রবীন্দ্র-সুহৃদ হয়ে সান্নিধ্যে থেকে এন্ড্রুজ আজীবন এই তিনটি ব্রত পালন করে রবীন্দ্র-জবানি ও জীবনীতে, শান্তিনিকেতনের ইতিহাসে, বাংলার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে, ভারতের শ্রমজীবী আন্দোলনের ইতিহাসে চিরস্মরনীয় হয়ে আছেন আজও।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...