রং-তুলি’র যোদ্ধা রেনবো গ্র্যান্ড’পা

 শিরা ওঠা হাত। আলাগা চামড়া। মুখের আদলে অজস্র বলিরেখা। বয়সের থাবায় ঝাপসা চোখের দৃষ্টি। বয়স পেরিয়ে গিয়েছে চার কুড়ি বসন্ত। পাহাড়ের গায়ে এক গ্রামে একা প্রহরীর মত রাত জাগে এক বৃদ্ধ। সহায় নেই। সম্বল বলতে রং আর তুলি। 

তাইওয়ানের ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামটাতে তিনিই শেষ বাসিন্দা। সবাই একে একে ঘর ছেড়েছে। অভাবের তাড়নায়। রুটি-রুজির তাগিদ। বাঁচার তাড়না। যেতে পারেননি একমাত্র তিনি। হুয়াং ইয়াং ফু। অশক্ত শরীরে গাঁ আগলে বসে।

কিন্তু সে অবস্থা বেশিদিন চলল না। তাইওয়ান সরকারের নজর পড়ল প্রায় শূন্য গ্রামে। সেই গ্রামের এক মাত্র বাসিন্দা ৮৭ বছরের হু ইয়াং ফু এর কাছে নোটিশ এলো বাসা করে অন্যত্র চলে যাবার। তার গ্রাম বদলে যাবে বহুতলের শহরে।

কিন্তু তাঁর যে যাবার মত কোনও ঠাঁই নেই। প্রথম জীবনে পেয়েছেন উদ্বাস্তু হওয়ার স্বাদ। জানেন ভিটে ছাড়া হবার যন্ত্রণা। তাইওয়ান সরকার জানাল তাকে কিছু টাকা দেবে। বিনিময়ে ছাড়তে হবে মাটি।

কিন্তু মাটি ছেড়ে যাবে কোথায়?

 দেশের রাজার সঙ্গে একা যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিলেন আজন্মের লড়াকু হু ইয়াং। তার হাতে শক্তি নেই। অস্ত্র নেই। তাইওয়ানের প্রান্তের এক অখ্যাত গ্রামে অশীতিপর বৃদ্ধ মানুষটি হাতে শুধুই রং আর তুলি। যা ছিল তার অবসরের খেলা, তাই যেন হয়ে উঠল প্রতিবাদের অস্ত্র। বেঁচে থাকার আশা। ভিটে টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার। 

রাগ, হতাশা, ভয় কথা বলে উঠতে লাগল ক্যানভাসে। কিন্তু এ ক্যানভাস কাঠের নয়। তার গ্রামের বাড়ির খোলা দেওয়ালউঠোন, মেঝেই হয়ে উঠল তার ক্যানভাস

দৃঢ় রেখায়, উজ্জ্বল রঙে একের এক ছবি তে ভরে উঠতে লাগল গ্রাম।

শুরুটা করেছিলেন নিজের বাংলোর দেওয়াল দিয়ে। প্রথম দিন বাড়ির বাইরের দেওয়ালে  চিনা শৈলীতে একটা ছোট্ট পাখি। তারপর একটা বিড়াল।  ধীরে ধীরে আরও অনেক। এক দেওয়াল ভরে গেলে আর এক দেওয়াল। ঝিমিয়ে পড়া গ্রাম রাতারাতি কথা বলে উঠল ভাইব্রেন্ট রঙের ছোঁয়ায়।

নিজের গ্রামে তাঁর দিন ক্রমশ কমে আসছিল। চাপ বাড়ছিল ঘর ছাড়ার। কিন্তু হঠাৎ যেন ম্যাজিকের মত বদলে গেল সবটা।

এক কলেজ ছাত্রর হাত ধরে। ২০১০ সালে স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বেড়াতে এসেছিল সেখানে। জনশূন্য গ্রামের রঙিন দেওয়ালগুলো চোখে পড়ে। দেওয়ালের গ্রাফিটির ছবিও তোলে কিছু। গ্রাফিটি শিল্পীর খোঁজ করতে করতে চলে আসে হু ইয়াং ফু –এর কাছে। ছবির গল্প জানার পর শরিক হয় তাঁর লড়াইতে। বাইরের দুনিয়ায় সে-ই ছড়িয়ে দেয় রেনবো গ্র্যান্ডপা’র কাহিনী।  রেনবো গ্র্যান্ডপা’র গাঁ বাঁচাতে শুরু হয় ক্যাম্পেনিং।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় তার গল্প। বহু মানুষ সাড়া দেয় এই ক্যাম্পেনিং-এ। তাইওয়ানের ‘গ্রাফিটি গ্রাম’ নজর কাড়ে টুরিস্টদের। অনেকেই আসতে শুরু করে ছবি দেখতে। গ্রাম দেখতে। কেউ কেউ আবার শুধু রেনবো গ্র্যান্ডপা কে দেখতে।

রাতারাতি খবরের শিরোনামে জায়গা করে নেন রেনবো গ্র্যান্ডপা। বিষয়টি জানতে পারে তাইওয়ান সরকার। জনমতের চাপে সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য হয়।

৪০ বছর আগে যখন হু ইয়াং ফু এই গ্রামে প্রথম থাকতে শুরু করেন তখন গ্রাম এমন একলা ছিল না। ,২০০ পরিবার থাকত। মানুষজনে ভর্তি থাকত গাঁ। উৎসবে-অনুষ্ঠানে হইহই করত সবাই। মিলেমিশে এক পরিবার। কিন্তু অর্থনীতির মন্দা ক্রমশ গ্রাস করে জনপদটিকে। ঘর ছাড়তে শুরু করে মানুষ। বেশির ভাগ চলে যায়। মারাও যায় অনেকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ২ মিলিয়ন মানুষকে জোর করে ঘর ছাড়া করা হয়। রাতারাতি উদ্বাস্তু হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে তাইওয়ানের নানা জায়গায় শেল্টার দেওয়া হয়। সেভাবেই এই গ্রামে আসেন হু ইয়াং ফু। জন্মেছিলেন চীনে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ন্যাশানালিস্ট পার্টি হেরে যায়। যুদ্ধ শেষে আর নিজের ঘরে ফিরতে পারেনি তিনি । আরও ২ মিলিয়ন মানুষের সঙ্গে তাঁর জায়গা হয় এই পাহাড়ি গ্রাম।

যুদ্ধের অসহায়তা, জীবনের হাহাকার তিনি দেখেছেন। রক্ত, ভয়, অন্ধকার অজানা নয়। তাই যেন সহজ সরল জীবনের ছবি ফুটিয়ে তোলেন দেওয়ালে দেওয়ালে। পাখি, বিড়াল, পান্ডা, মাছ। মুখের অবয়ব। উচ্ছল জীবন। উৎসব, হাসিতে বর্ণময়। কোথাও কোনও বিষাদ নেই। অবসাদ নেই। দেওয়ালে দেওয়ালে লাল, নীল, হলুদ। ভালবেসে আকঁড়ে ধরতে চাওয়া জীবন। ভয়হীন ভাবে বাঁচতে চায়। 

তাইওয়ানের অখ্যাত, জনহীন গ্রামে এখন বছরে ১ মিলিয়ন টুরিস্ট আসে নিয়মিত। বদলে গিয়েছে সেখানকার অর্থনীতি। ঘরে ফিরতে চাইছে গ্রামের চলে যাওয়া মানুষরা। 

রেনবো গ্র্যান্ড পা এখন ৯৭। খুব খুশি। তাইওয়ান সরকার হু ইয়াং ফু কে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাঁর গ্রাম যেমন আছে ঠিক তেমনটাই থাকবে। কোনওদিন বদলে যাবে না। 

একা মানুষ কতখানি শক্তিশালী হয়ে উঠতে হতে পারে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। শিল্পের প্রতি নিজে প্যাশনের প্রতি সৎ থাকলে সেটাই বেঁচে থাকার বড় হাতিয়ার। হু ইয়াং ফু গ্রামে ১,২০০ টি পরিবার বাস করত এক সময়। তাঁরা এক বড় পরিবারের মত থাকতেন। কিন্তু এক এক করে সবাই চলে যায়। শুধু একা র‍য়ে গেলেন তিনি। তাঁর কোথাও যাওয়ার ছিল না। মাটির টান কাটাতে পারেননি। এখন সেই গ্রাম আবার ভরে উঠেছে। এক নব্বই ছোঁয়া এক বুড়ো মানুষের টানে শূন্য গাঁ খানা আবার জমজমাট।      

 

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...