আশি নট আউট!

আশিতে এসেও অটুট মানিকজোড়-টম অ্যান্ড জেরি

ইঁদুর বেড়ালের মিষ্টি খুনসুটির গায়ে লাগালো আশিতম বসন্তের হাওয়া।

ঠাস-ঠকাস-দ্রুম-দ্রাম-পটাশ...বুম

এই একটা শব্দ টিভির পর্দায় ভেসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই মুখের অভিব্যক্তি বদলেছে সকল শিশুর।টিভির রিমোট হাতে পেলেই কতক্ষণে কার্টুন নেটওয়ার্ক চ্যানেলে পৌঁছনো যায়!

tom-1

টম অ্যান্ড জেরি –র অপেক্ষায় বিকেলের পর বিকেল কেটে গিয়েছে এভাবেই।

ছোট্ট ইঁদুরের দুষ্টুমিতে বিরক্ত বেড়াল। চিজ খাইয়ে  বিপদে ফেলার ছক   ইঁদুর বুদ্ধিমান। চিজ চেটেপুটে সোজা নিজের গর্তে।  তার টিকি ছোঁয়ারও জো নেই!

 এই চেনা গল্পে সেজে উঠেছে কতনা শিশুমন।বাড়ির ড্রয়িং রুম।ছেলেবেলার আড্ডা। সেই নির্মল মজা বাঁধা মানেনি কোনও দেশ-কাল-সীমানার বেড়াজাল।

গত শতকের ৪০ এর দশক। আমেরিকা ও তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার ঠান্ডা লড়াইয়ের আবহ আকাশে বাতাসে।এদিকে ক্ষমতার উল্লাসে মজে তাণ্ডব চালাচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

এই পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রযোজনা সংস্থা এমজিএম স্টুডিয়োর অ্যানিমেশন বিভাগে কাজ করছেন বিল হ্যানা এবং জো বারবেরা। অন্য সংস্থার পর্কি পিগ বা মিকি মাউসের জনপ্রিয়তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবছেননা।

 হ্যানা তখন ৩০-এর নীচে। ভাবতে বসলেন নিজেদের মতো করে। বারবেরা বললেন, সাধারণ ইঁদুর-বেড়ালের কার্টুন  কেমন হতে পারে? তাদের চেনা স্বভাবে সেজে উঠবে গল্পের ঢং?

খুব আনকোরা নয় ঠিকই; ঝুঁকিটা নিয়েই ফেললেন দুই সহকর্মী।

 ১৯৪০ সাল১০ ফেব্রুয়ারি। ইঁদুর-বেড়াল এর প্রথম গল্পের স্বাক্ষী থাকল গোটা পৃথিবী। ‘পাস গেটস দ্য বুট’।নির্ভেজাল আনন্দের নিঃশব্দ ক্যাপস্যুল। তখন তাদের নাম ছিল জ্যাসপার আর জিঙ্কস।

ব্যস্‌! উড়ে গেল রকেট। অ্যানিমেটেড এই শর্টের ঝুলিতে এসেছে অস্কারও।যদিও কৃতিত্বের ভার থেকে বঞ্চিত হলেন এক অর্থে জনক-জননী হ্যানা-বারবেরা। সংস্থার সঙ্গে কিছু মনোমালিন্য চলছে।  

এই সময়ে টেক্সাস থেকে চিঠি এল একজন প্রভাবশালী শিল্পপতির ।  জানতে চাইলেন, মজার বেড়াল-ইঁদুরকে আবার কবে দেখা যাবে?

 জ্যাসপার আর জিঙ্কস হয়ে উঠলো টম আর জেরি।আবার হল খেলা শুরু।

 এই দুষ্টুমিকে কথার মোড়কে ঢালতে কিছু ভাবেননি স্রষ্টারা। আবহে স্কট ব্র্যাডলির তৈরি মিউজিক। টমের গলায় মানুষের মতো চিৎকারের শব্দ দিয়েছিলেন হ্যানাই।

tom-2

আগামী দুই দশকে এসেছে ১০০টি  শর্ট । সপ্তাহের পরে সপ্তাহ লেগে যেত একটা শর্ট বানাতে।

তবে প্রশ্ন থাকতে পারে কুড়ি বছরে মাত্র ১০০ বার প্রকাশ!এত জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও!উত্তরে জানা যায় এর পিছনে ছিল খরচের শাসানি।প্রতি ছবি পিছু প্রায় ৫০ হাজার ডলার। তাই বছরে খুব বেশি সংখ্যক শর্ট বানানো সম্ভব ছিল না।

’৫০-’৫৭-‘৭০।বিভিন্ন সময়ে হাত বদল হয়েছে বেড়াল ইঁদুরের।যদিও স্বভাবে পরিবরতন আনেননি কেউই।তত দিনে টম-জেরির প্রথম দিককার এপিসোড নিয়ে  উঠেছে নানা আপত্তি।

এতে সবে অবশ্য টম-জেরির জনপ্রিয়তায় আঁচ আসেনি।

টম খুব অল্পতেই রেগে যাওয়া স্বভাবের। জেরি খুব স্বাধীন আর সুযোগ সন্ধানী। টমের সঙ্গে জেরির মানসিকতার কোনোই মিল নেই। প্রতিটি কার্টুনেই সাধারণত জেরিকে বিজয়ী  আর টমকে জয়ের মুকুটে দেখা যায়।

 এই হারজিত খেলার আড়ালেই পাতা গজায় এক নতুন বন্ধুত্বের।

১৯৫৬ সালের ১৬ নভেম্বর। ব্লু ক্যাট ব্লুজ একটি ব্যতিক্রমিক  এপিসোড।এর একটা আলাদা ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। যারা দেখেছেন নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন।

দেখা যায়, মন মরা জেরি বসে আছে রেল ট্র্যাকে । সে বলতে শুরু করে তার মন খারাপের কথা। এই দিক দিয়েও  এপিসোডটি ব্যতিক্রম। কেননা, জেরি গোটা গল্প শোনাচ্ছে, এমন এপিসোড খুবই কম।

কারণ, টম এক সুন্দরী ধবধবে সাদা বিড়ালের প্রেমে পড়েছিল।  সেই সুন্দরী তাকে প্রাথমিক ভাবে পাত্তা দিলেও পরে এক ধনী বিড়ালকে বেছে নেয় জীবনসঙ্গী হিসেবে।

প্রেমে ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ আত্মহননের পথ বেছে নেয় টম। চিরকালের শত্রু জেরি কিন্তু টমকে এই অবস্থায় ছেড়ে যায় না। সে চেষ্টা করে তাকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু পারে না।

শেষমেশ নিজেকে শেষ করতে রেল ট্যাকে এসে বসে টম। এবারও তাকে ছেড়ে যায় না জেরি। ট্রেনের অপেক্ষায় বসে থাকা টমের পাশে বসে থাকে সেও। ট্রেনের হুইসেলের শব্দ শোনা যায়।

টার্নার এন্টারটেনমেন্ট-এর চ্যানেল কার্টুন নেটওয়ার্কও বুমেরাং এই এপিসোডকে ব্যান করে দেয়। কেবল আত্মহত্যাই নয়, তাদের দাবি ছিল, এই এপিসোডে টমকে মদ্যপান করতেও দেখা গিয়েছে। যদিও  টম মদ খায়নি। সে বোতলে করে দুধই খাচ্ছিল।

পরে কার্টুন নেটওয়ার্ক সাউথইস্ট এশিয়ায়  এই এপিসোডটি দেখানো হয়েছিল। তবে  এটা ‘টম অ্যান্ড জেরি’-র শেষ এপিসোড নয়। ১০৩ নম্বর এই এপিসোডের পরেও অরিজিনাল সিরিজটি চলেছিল ১১৪ তম এপিসোড পর্যন্ত।

তবে অরিজিনাল সিরিজের পরে বিখ্যাত অ্যানিমেটর চাক জোন্স নতুন করে ফিরিয়ে আনেন টম জেরিকে। তিনি তৈরি করেন আরও ৩০টি এপিসোড। পরে আরও নানা ছবি ও শর্ট এপিসোডে ফিরে ফিরে আসে আদরের জোড় টম জেরি।

টম ও জেরির  বৈশিষ্ট্যই হল ধারাবাহিকতা নয়, স্বাতন্ত্র্যতা।

জেরিকে বিরক্ত করে মজা পাওয়া। প্রতিশোধ নেওয়া। টমের ভয়ঙ্কর ও অসৎ পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়া। ভুল বোঝাবুঝি।

সাধারণত এ ধরনের পর্বগুলো দুইজনের মধ্যেই বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থায় শুরু হয়। সংঘর্ষ হয় যখন দু'জনে একই জিনিস চায় ।সাধারণত খাবার।

জেরিকে সরিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আসে সেখানেই।তবুও এই  বিষয়গুলো ছিল দু'জনের কাছেই উপভোগ্য খেলা।

আত্মহননের এপিসোডে যখন দেখা যায় ট্রেনের হুইসেল কে উপেক্ষা করেও জেরি টমের পাশ ছাড়েনা; বাতাসে তখন বন্ধুত্বের নতুন গান তৈরি হয়।তাই প্রতিযোগিতার থেকেও বড়- টম আর জেরি নিজেদের নীরব বন্ধুত্বের পরিচয়ই দেয়।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...