হাওড়া থেকে বর্ধমানের ট্রেনে বলগোনা হয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় আউষগ্রাম। সেই গ্রামেই রয়েছে একটি অভিনব পাঠশালা, যেখানে সকাল থেকেই শিক্ষার পাঠ নিতে চলে আসে পড়ুয়ারা। আর তার পাঠ দেন সবার প্রিয় মাস্টারমশাই সুজিত চট্টোপাধ্যায়। চাকরি থেকে অবসরের পর কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলেন না কি করে সময় অতিবাহিত করবেন। ঠিক সেই সময় তিন ছাত্রীর আগমন হয় তাঁর বাড়িতে। তাঁদের পড়ানোর অনুরোধ জানান মাস্টারমশাইয়ের কাছে। শুধু তাই নয়, তাঁর কাছে ক্লাস করার জন্য প্রতিদিন ২০ কিমি যাতায়াত করতেও যে তাঁরা প্রস্তুত, তা দেখে বিস্মিত হয়ে যান ৭৬ বছরের এই শিক্ষক। শিক্ষার প্রতি এমন প্রবল আগ্রহ দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন, এবং শুরু করে দেন ‘সদাই ফকিরের পাঠশালা’।
বর্তমানে প্রায় ৩৫০-এরও অধিক ছাত্রছাত্রী তাঁর কাছে ক্লাস করতে আসে, যাদের মধ্যে অধিকাংশ পড়ুয়াই আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। ক্লাসের ৮০ শতাংশ পড়ুয়াই নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। রবিবারের অলস সকালে যখন অন্যান্যরা অবসরের সুযোগে কিঞ্চিত গা এলিয়ে থাকেন, তখনও তিনি ব্যস্ত থাকেন শিক্ষাকৌতুহলী পড়ুয়াদের ক্লাস দিতে। বছর পিছু মাত্র ২ টাকা টিউশন ফিজ নেন, তাও সৌজন্যতার খাতিরে। বাংলাই হোক বা ভূগোল, যে কোনো বিষয় পড়ানোর সময় মূল লক্ষ্য থাকে যাতে পড়ুয়ারা বাইরের পৃথিবী সম্বন্ধে পূর্ণমাত্রায় ওয়াকিবহাল হয়।
অবসর পূর্বে রামনগর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রিন্সিপালের দায়িত্বে ছিলেন। ২০০৪ সালে অবসর গ্রহণের পর বর্ধমানের আউষগ্রামে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘সদাই ফকিরের পাঠশালা’। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের সমাজ বিজ্ঞান ও স্নাতক স্তরের শিক্ষার্থীদের বাংলা ক্লাস করান। শিক্ষকতার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক পরিবেশ নিয়ে সচেতনতার বার্তা প্রচার করার ক্ষেত্রেও সক্রিয়ভাবে লড়াই করে আসছেন তিনি। কলকাতার ক্যাকোফনি বিছিন্ন এই প্রত্যন্ত গ্রামে থেকেও সাম্যের পক্ষে এবং বৈষম্যহীন পরিবেশবান্ধব সমাজ গড়ে তোলার জন্য এখনও সদর্পে নিজস্ব প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন এই প্রবীণ।
ভোর ৬টা থেকে শুরু হয়ে যায় সদাই ফকিরের পাঠশালা। কখনও কখনও শীতের হাড়হিম সকালে সূর্য ওঠার আগেই শুরু করে দেন ক্লাস, চলে সন্ধ্যে ৬টা অবধি। উচ্চমানের বিদ্যালয় থেকে কোনো অংশেই কম নয় এই পাঠশালা। অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টার থেকে শিক্ষক-অভিভাবক মিটিং, সমস্ত কিছুই নিষ্ঠার সাথে সম্পাদিত হয়ে থাকে এখানে। কিন্তু গোটা পাঠশালা তো একার পক্ষে সম্পাদনা করা সহজ নয়। তাই এ বিষয়ে ভাইপো উৎসব যাবতীয় সাহায্য করে থাকেন।
উৎসবের বয়ান, শিক্ষকতার চাকরি খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়লো যে আমাদের বাড়িতেই তো স্কুল রয়েছে। জেঠুর প্রতি সবসময়ই বিনয়ী শ্রদ্ধা পোষণ করতাম আমি। এই মহৎ উদ্যোগে অংশ নিতে পেরে আমি গর্বিত।
উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থার পাশাপাশি ঐ অঞ্চলে কিছু স্কুল-কলেজ স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে একাধিক চিঠি লিখলেও তার একটিও বিবেচনা করে দেখা হয় নি। ক্লাস করার উদ্দেশ্যে দূর দূরান্ত থেকে বহু ছাত্রী প্রতিদিন ২০-২৫ কিমি পর্যন্ত যাতায়াত করে, যেখানে ছাত্রদের সাইকেলে ৪০-৪৫ কিমি পর্যন্ত যাত্রা করতে হয়। একমাত্র একটি নামী বাণিজ্যিক পত্রিকা ছাড়া তাঁর এই সৃষ্টীশীল অনন্য কৃতিত্বকে তুলে ধরতে প্রায় কেউই এগিয়ে আসেননি। সম্প্রতি দ্যি টেলিগ্রাফ এড্যুকেশন ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে দেশের একজন আদর্শবান নাগরিক হিসেবে তাঁকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডে পুরষ্কৃত করা হয়।
অনন্য শিক্ষাপ্রণালীর জন্য শিক্ষার্থীদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন এই ৭৬ বছর বয়সী শিক্ষক। প্রিয় মাস্টার মশাইয়ের ক্লাস কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চায় না তাঁরা। সুজিত চট্টোপাধ্যায়ের প্রাক্তন ছাত্র পীযূষকান্তি ঘোষ বর্তমানে বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন, সমাজের অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের রুখে দাঁড়ানোর ব্যাপারটিকে তিনি বরাবরই প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন। ব্যক্তিত্বতে প্রতিফলিত না হলে পড়াশোনা যে শুধু পাঠ্যপুস্তকেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে তা পড়ানোর সময় আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতেও ভুলতেন না। আমাদেরকে নিজের সন্তানের মতো করে দেখতেন তিনি।
শিক্ষকতা ছাড়াও গ্রামের যে কোনো কাজে সর্বদাই নিযুক্ত থাকেন মাস্টারমশাই। পড়ুয়াদের সাথে না থাকলে তাকে হয় তো দেখা যাবে, জামা কেনার জন্য কাউকে অর্থদান করছেন অথবা নিরক্ষর কোনো মানুষের গুরুত্বপূর্ণ চিঠি দায়িত্ব সহকারে লিখে দিচ্ছেন। এমনই বিচিত্র তাঁর জীবন। ২০১৫ তে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত মানুষদের জন্য উদ্যোগ নিতে শুরু করেন। তাদের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে পড়ুয়াদের নিয়ে তৈরী করেন একটি সংস্থা। থ্যালাসেমিয়া সম্বন্ধে বিস্তারিত অধ্যয়ন করে ছাত্রদের নিয়ে গ্রামে ঘুরে ঘুরে চালিয়ে যান সচেতনতামূলক প্রচার। ক্রমেই তা নিত্য কর্মসূচিতে পর্যবসিত হয়। দেশের আগামী প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের আদর্শবান শিক্ষায় শিক্ষিত করতে সারাজীবন নিযুক্ত করেন তিনি। তাঁর উদ্দেশ্য, মানবিকতা ও মূল্যায়নের কাছে গুটিকয়েক শিক্ষকই পৌঁছতে পারেন।