তারুন্যের উচ্ছ্বাসে নতুন দিশা ভারতীয় রাজনীতিতে

২০১৯ এর ১৭ তম লোকসভা নির্বাচনে গোটা দেশে প্রথমবার

ভোট দিচ্ছে এমন ভোটারের সংখ্যা ছিল ৮.২ কোটি। সংসদে

নির্বাচিত ৬৪ জন সদস্য ৪০ বছরের নীচে। বাকি ২২১ জন গড়ে

৪১ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে।

 

সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোই এবারের নির্বাচনে জোর দিয়েছে কম

বয়সী প্রার্থী বেছে নেওয়ার ওপর। উদ্দ্যেশ্য দেশের তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতির দিকে টানা। টেকস্যাভি জেনারেশনের সঙ্গে তাল মেলাতে চাওয়া। কিছুটা হলেও বদলে গিয়েছে ভারতীয় সংসদের ছবিটা।

পার্লামেন্টের অলিন্দে এখন তারুন্যের হাওয়া। লোল চর্ম, পক্ককেশ দের পরিবর্তে মধ্য তিরিশের ইয়াং ব্রিগেড।

দেখে নেওয়া যাক সেই ইয়াং ব্রিগেড এর সংক্ষিপ্ত বিবরণ-

 

চন্দ্রানি মূর্মু (২৫)

বিজেডি

এবারের লোকসভা নির্বাচনে সবচেয়ে কম বয়সে এমপি নির্বাচিত

হয়েছেন চন্দ্রানি মূর্মু। বি টেক গ্র্যাজুয়েট ২৫ বছর বয়সী

চন্দ্রানী ওড়িশার কেওনঝাড় লোকসভা আসন থেকে নির্বাচিত

হয়েছেন। উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল। স্থানীয় বিজেডি দলের

প্রার্থী হিসেবে তিনি বিজেপির দুইবারের সংসদ সদস্য অনন্ত

নায়ককে বিপুল ভোটে পরাজিত করেন। চন্দ্রানি মুরমু বলেন,

পড়াশোনা শেষ করে চাকরি খুঁজছিলাম। এর মধ্যে বিজেডি দলের

কাছ থেকে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব আসে। প্রথমে ভয়

পেয়েছিলাম। তারপর অনেকেই উৎসাহ দেয়। জয় পাব ভাবিনি।

 

জামিয়ং তেসিং নামগাল (৩৩)

বিজেপি

লাদাখ থেকে বিজেপির হয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে

জামিয়ং তেসিং, তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। লাদাখ থেকে নির্বাচিত

সব চেয়ে কম বয়সী সংসদ সদস্য। তবে এর আগেও নির্বাচনে

 

প্রার্থী হয়েছেন জামিয়ং। লাদাখ অটোনোমাস হিল ডেভলপমেন্ট

কাউন্সিলের নির্বাচনে। ২০১৫ সালে জিতে আসেন।

 

কবিতা সিং (২৯)

জনতা দল

২০১১ সাল নাগাদ অনলাইনে একটি বিজ্ঞাপন নজরে আসে

কবিতার। অজয় সিং আরজিডি দলের নেতা বিয়ের জন্য পাত্রী

খুঁজছেন। রাজনৈতিক নেতার বিয়ের জন্য এমন বিজ্ঞাপন অবাক

করার মতই।

অজয় সিং এর মা জগমাতো দেবী বিহারের দারান্দা কেন্দ্রের এম

পি ছিলেন। হঠাৎ তিনি মারা যান। সেই আসনে প্রার্থী হতে চান

ছেলে অজয়। কিন্তু ক্রিমিনাল কেসের রেকর্ড থাকার কারনে

তাঁকে প্রার্থী করতে রাজি হয়নি দল। তবু নাছোড়বান্দা অজয়।

এই অবস্থায় বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার অজয়কে বিয়ে

করার পরামর্শ দেন। কারণ একটাই, ওই আসনে অজয় সিং-এর স্ত্রীকে

প্রার্থী করা হবে।

সেইমত অজয় বিয়ে করলেন কবিতাকে  এবং নির্বাচনে প্রার্থী হলেন

কবিতা। ২০১১-এ দারুন্দায় উপ নির্বাচনে জয়ও আসে। ২০১৫

বিধানসভা নির্বাচনেও ভাল ফল করেন।

২০১৯ এর নির্বাচনে জনতা দল সিয়ান থেকে তাঁকে প্রার্থী

করে। ২০১৪ সালে আসনটি ছিল বিজেপির। আবার টিকিটের জন্য

 

দাবী জানান অজয়। কিন্তু এবারও তাঁর দল কবিতাকেই বেছে নেয়।

বিজেপি’র হিনা সাহাবকে পরাজিত করেন।

চার চারবার নির্বাচনে দারিয়ে এখনও পর্যন্ত একবারও হারেননি

কবিতা। কন্তু তিনি নিজেকে এখনও ‘হাউসওয়াইফ’ বলতেই বেশি

ভালবাসেন। নিজের রাজনৈতিক কেরিয়ার নিয়ে বলেন, আমি জগমাতো

দেবীর ঐতিহ্য বহন করছি মাত্র।

 

প্রবীন কুমার নিশাদ(৩০)

বিজেপি

হামারি লড়াই সমাজ মে হিস্যেদারি কি হ্যায়- উত্তর প্রদেশের

রাজনীতির মঞ্চে দলিত সম্প্রদায়ের কন্ঠ তিনি। প্রবীণ কুমার

নিষাদ। ৩০ বছর বয়সী এই বিজেপি নেতা ২০১৯ ‘র লোকসভা

নির্বাচনে সন্ত কবীর নগর থেকে জয়ীপ্রার্থী।

বছর তিরিশের নিষাদ বলেন, উত্তর প্রদেশে ১৮ শতাংশ দলিত

সম্প্রদায়ের মানুষ। অপরিসীম দারিদ্র্য আর অব্যবস্থার মধ্যে

তাদের বেঁচে থাকতে হয়। আগামী পাঁচ বছর তিনি সংসদে তাঁর

সম্প্রদায়ের মানুষদের অধিকার দাবী আদায়ের জন্য কাজ

করে যাবেন বলে জানিয়েছেন। ৩৫,৭ ৪৯ ভোটে প্রবীণ কুমার

নিষাদ বিএসপি’র ভীষ্ম শংকরকে হারিয়েছেন।

২০০৯ সালে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। ২০১৪ সালে

রাজনীতিটে হাতেখড়ি। শুরু করে ছিলেন বাবার দলে। রাষ্ট্রীয়

নিষাদ একতা পরিষদে। পরে বিজেপি তে যোগ দেন। দলিতদের জন্য

সংরক্ষণ চান তিনি।

 

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (৩১)

তৃণমূল কংগ্রেস

২০১৪ সালে রাজনীতিতে যোগ দেন। ২০১৬ সালে প্রথম

পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ

সদস্য। সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের অভিষেক

বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বছরও লোকসভা সদস্য তিনি । ডায়মন্ড

হারবার থেকে ৩.২ লক্ষ ভোটে জয়ী হন। ২৩ বছর বয়সে

সর্বভারতীয় তৃণমূল যুবকংগ্রেসের সভাপতি হন।

 

নুসরত জাহান রুহি (২৯)

তৃনমূল কংগ্রেস

টলিউডের প্রথম সারির অভিনেত্রী। মডেলিং-ও করে থাকেন। তবে

সংসদে প্রবেশের পর আগের জীবনে কতটা বদল আসবে সেটাই

দেখার। নুসরত জাহান, পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্র

থেকে সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের বিজয়ী প্রার্থী। লোকসভা

নির্বাচনে তাঁর মনোনয়নে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় বয়ে গিয়েছিল।

ট্রোলড হতে হয়েছিল তাঁকে। বিজেপি প্রার্থী সায়ন্তন বসুকে

প্রায় তিন লক্ষের বেশি ভোটে পরাজিত করেন। তবে রাজনীতির

মঞ্চে এলেও নিজের অভিনয় জীবন ছাড়ার কথা ভাবছেন না তিনি।

দু’য়ের মধ্যে ব্যালেন্স করার পক্ষপাতি তিনি। সংসদের অধিবেশনে

ব্যস্ত থাকলেও সিনেমার অ্যাসাইনমেন্টে তার প্রভাব পড়বে না

বলেও জানিয়েছেন।

 

মিমি চক্রবর্তী (৩০)

তৃনমূল কংগ্রেস

মিমি চক্রবর্তী। অভিনেত্রী। নুসরত জাহানের মতই লোকসভা

নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক জীবনের শুরু। যাদবপুর কেন্দ্রের

তৃনমূল কংগ্রেস প্রার্থী। নুসরতের মতই তাঁকেও সোশ্যাল

মিডিয়ায় ট্রোলড হতে হয়েছিল। বিজেপি প্রার্থী অনুপম হাজরাকে

২.৯৪ লক্ষ ভোটে পরাজিত করেছেন তিনি। সংসদের প্রথম দিনে মিমি আর নুসরতের জিনস-টি শার্টের ছবি সামনে আসতেই আবার আরেক দফা ট্রোলড হন। মিমি জানিয়েছেন সরাসরি রাজনীতিতে তাঁকে এই প্রথম দেখা

গেলেও তাঁর পরিবারের সকলেই সক্রিয় তৃণমূলকর্মী। তিনিও সেই

ঐতিহ্য বহন করছেন।

 

গদেতি মাধবী (২৬)

ওয়াইএসআর কংগ্রেস

 

বিশাখাপত্তন্মের আরাকুর পাদেরুর একটি উপজাতি স্কুলে

ফিজিক্যাল এডুকেশনের শিক্ষিকা গদেতি মাধবী। প্রয়াত

সিপিআই নেতা গেদেতি দেমেদু’র কন্যা তিনি। ওয়াইএসআর

কংগ্রেস পার্টি’র হয়ে আরাকু কেন্দ্রে লোকসভা প্রার্থী হন।

টিডিপি নেতা ভি কিশোরচন্দ্রা দেও এর বিপক্ষে।

কম্পিউটার সায়েন্স এবং ফিজিক্যাল এডুকেশনের ছাত্রী ছিলেন।

মাধবী জানিয়েছেন, রাজনীতি তাঁর কাছে নতুন নয়। তাঁর বাবার

জন্য ছোট থেকেই বাড়িতে রাজনীতির পরিবেশ ছিল। সেভাবেই

 

বেড়ে ওঠা। উপজাতি মানুষদের সমস্যা সামনে থেকে দেখেছেন

তাদের অধিকার আদায়ের জন্যই সংসদে লড়াই করবেন মাধবী।

 

এল সি তেজস্বী সূর্য (২৪)

বিজেপি যুব মোর্চা

পেশায় আইনজীবি তেজস্বী সূর্য রাজনীতিতে পা রাখেন

কর্ণাটকের বিজেপি যুব মোর্চার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে।

দক্ষিনের রাজ্যটিতে বিজেপি নতুন মুখ খুঁজছিল। সেই সময় উথে

আসেন চব্বিশের তেজস্বী। তিনি বলেন যদি ২৫ বছরে আইপিএস

অফিসার, ২৫ বছরের এসপি, ২৫ বছরে ভারতীয় ক্রিকেট দলের

ক্যাপ্টেন যদি হওয়া যায় তাহলে এমপি কেন নয়? তারাই দেশের

যুবসমাজের দাবীকে সংসদে পৌঁছে দিতে পারবে।

 

এরা ছাড়াও প্রজ্জল রেভানা(২৮), হেনা গাভিত(৩১),ইন্দ্রা হং

সুব্বা(৩০), কিনিজারাপু রামমোহন নাইডু(৩২), হিমাদ্রি

সিং(৩২),রাকেশ খাদিশ(৩২), শ্রীকান্ত একনাথ সিন্ধ্রে(২৭)

প্রমুখরা এবারের লোকসভা নির্বাচনে আনকোরা মুখ। প্রথমবার

পার্লামেন্টের অন্দরে পা রাখলেন তাঁরা। এতদিন ভারতীয় রাজনীতির চেহারাটা এবারের নির্বাচনে যেন রাতারাতি বদলে গেল। সব রাজনৈতিক দল-ই ট্র্যাডিশন ভেঙে নতুন মুখকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দিয়েছে দলে। রাজনীতির ময়দানে

নতুন বা অভিজ্ঞতা কম বলে তরুণ প্রজন্মকে দূরে বসিয়ে রাখার

পরিবর্তে সংসদে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়েছে। সাদা চুল পাকা

মাথাদের পরিবর্তে ঝকঝকে, স্মার্ট মুখ। ভারতীয় রাজনৈতিক

 

ধারার পরিবর্তন আদৌ কি রাজনীতিমুখি করতে পারবে

ভবিষ্যতের নাগরিকদের। সংসদের অধিবেশন পুরোমাত্রায় শুরু

হলে হয়ত স্পষ্ট হবে ছবিটা।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...