আমাদের চারপাশের দুনিয়া এখন জাল বিস্তার করে চলেছে। এই জালে ধরা পড়ছে সুদূর আমেরিকান কোনো গ্রামের সঙ্গে আমাদের ভেতো বাঙালিদের প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করা মানুষজন। রয়েছি আমরা- আপনারা সকলেই। ঠিক যেমনভাবে মাকড়সা জাল বিস্তার করতে করতে প্রায় সারা বাড়ি ছেয়ে ফেলে, তেমনিভাবেই আমরা সকলেই সারাবিশ্ব জুড়ে এক সুতোয় বাঁধা পড়েছি। আর কিছুই নয়। এতক্ষনে যাঁরা পড়ছেন, তাঁরা জেনেই গেছেন, কথা বলছি নেট দুনিয়া নিয়ে। বেশ কিছু দিন হল এই নেট দুনিয়া আস্তে আস্তে ঘিরে ধরেছে আমাদের।
১৯৮৯ সালের মার্চ মাসে ৩৩ বছরের ব্রিটিশ বিজ্ঞানী তথা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার স্যার টিম বার্নার্স লি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (www বা ডব্লিউ থ্রি) আবিষ্কার করেন। ন'য়ের দশকের শেষে বিশ্বব্যাপী তথ্যের ভাঁড়ার সৃষ্টির পর থেকে আমাজন, টেমস বা গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে তা বলাই বাহুল্য। অগ্রগতি ঘটেছে সফটওয়্যার, তথ্যপ্রযুক্তি বা ইন্টারনেট নির্ভর প্রযুক্তির ক্ষেত্রে।
আসুন আজকে একটু আলোচনা করি শুরুর সেই সময়টা নিয়ে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক হওয়ার পর সার্ন-এর সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পদে যোগ দেন বার্নার্স লি। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অবস্থিত ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ- যা সার্ন নামেই পরিচিত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিজ্ঞানীরা গবেষণার জন্য এখানে আসেন। কিন্তু সেই সময় বার্নার্স লি লক্ষ্য করেন, তথ্য আদান-প্রদানের জন্য ব্যাপক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে গবেষক বিজ্ঞানীদের। কারণ সেই সময় বিভিন্ন তথ্য কম্পিউটারে রাখা থাকত। তা পেতে গেলে আলাদা আলাদা কম্পিউটার লগ ও করতে হচ্ছে গবেষকদের। যার কারনে কাজের সময় নষ্ট হচ্ছে বেশ। আসছে বিরক্তি। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- এর থেকে কফি খাওয়ার সময় প্রয়োজনীয় তথ্য জিজ্ঞেস করে নেওয়া বেশি সহজ ছিল। এই ধারণা থেকেই তিনি ১৯৮৯ সালের ৪ মার্চ তাঁর উচ্চপদস্থ আধিকারিক মাইক সেন্ডেলের কাছে একটি প্রস্তাব জমা দেন। সেটি ছিল আজকের ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ তৈরী করার জন্য 'ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট: আ প্রপোজাল'। প্রস্তাবটি পরে কিছুই আঁচ করতে পারেননি সেন্ডেল। শুধু লিখেছিলেন- 'ভেগ ব্যাট এক্সাইটিং' (ব্যাপারটি অস্পষ্ট কিন্তু রোমাঞ্চকর)। সেই নোটের সবশেষে লেখা ছিল 'এন্ড নাও'? এরপরেই সহকর্মীদের নিয়ে হাইপার টেক্সট মার্ক আপ ল্যাঙ্গুয়েজ(HTML) লেখা শুরু করলেন বার্নার্স লি। তৈরী করা হল হাইপারটেক্সট ট্রান্সফার প্রোটোকল(HTTP)। ইউনিফর্ম রিসোর্স লোকেটর(URL)-এর ওপর নির্ভর করে ১২ মার্চ আত্মপ্রকাশ করল ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব। ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ নাম চূড়ান্ত হবার আগে যে নামগুলি ভাবা হয়েছিল, 'মাইন অফ ইনফরমেশন', 'দ্য ইনফরমেশন মাইন', 'ইনফরমেশন মেশ'। এরপর ১৯১৯ সালে তৈরী হল প্রথম ওয়েবসাইট যা আজও অনলাইন হিসেবে রয়ে গেছে। ওয়েবসাইট একসেস করতে গেলে তো ব্রাউজার প্রয়োজন। বার্নার্স লি ও তার টিম ১৯৯২ সালে তৈরী করল প্রথম ওয়েব ব্রাউজার। সেটা ছিল 'লাইন মোড' ব্রাউজার। প্রসঙ্গত বলা ভাল, ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব আর ইন্টারনেট যে আলাদা তা ব্যাখ্যা করতে স্রষ্টা বার্নার্স লি বলেছেন, ইন্টারনেট হল অসংখ্য কম্পিউটার একে অপরের সঙ্গে যুক্ত করে একটি সুবিশাল নেটওয়ার্ক। যার অস্তিত্ব বহু আগে থেকেই রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব হল - এইচটিএমএল, ইউআরএল এবং এইচটিটিপি দিয়ে তৈরী একটি অনলাইন এপ্লিকেশন। তবে আজকের নেট দুনিয়া যেভাবে বলা ভাল যে পদ্ধতিতে অথবা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা একেবারেই চাননি বার্নার্স লি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ক্ষমতাশালীরা তাদের নিজেদের স্বার্থে নেট-কে ব্যবহার করছে। বৈষম্য ও বিভাজনের ইঞ্জিনে পরিণত হয়েছে ওয়েব। তবে এটাও ঠিক, ওয়েব হল সবার জন্য। আরো সুন্দর, সুসংহত ও সুসংবদ্ধ পৃথিবী তৈরী হোক এই নেটের মাধ্যমে- সেটাই কাম্য।