সমাজের ‘ট্যাবু’ ভেঙে বাস চালাচ্ছেন ‘ধন্যি মেয়ে’ প্রতীক্ষা

ভারতে সিভিলাইজেশনের পরবর্তী সময় থেকে মহিলাদের দেখা গেছে বিভিন্নরকম কাজ দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে, যেগুলি মূলত পুরুষশাসিত কাজ। আর তার মধ্যে অন্যতম হল যান চালকের কাজ অর্থাৎ ‘ড্রাইভিং’। পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মহিলাদের গাড়ি চালানোর ঘটনা এ দেশে বিরল নয়। সাধারণত মহিলাদের দু’চাকার এবং চার চাকার যানবাহনে চালকের আসনে সওয়ার হতে দেখা যায়। কিন্তু কখনও কি দেখেছেন নগরের রাস্তায় কোনও মহিলাকে যাত্রী বোঝাই বাস চালাতে? হ্যাঁ, এমন কান্ডই ঘটিয়ে ফেলেছেন মুম্বইয়ের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার প্রতীক্ষা দাস

সম্প্রতি মহারাষ্ট্রের মালাদ অঞ্চলের ঠাকুর কলেজ থেকে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পর্ব শেষ করেছেন প্রতীক্ষা। তাঁর বয়সী আর পাঁচটা তরুণ-তরুণী যেভাবে জীবনযাপন করেন, সেভাবেই জীবনযাপন করে থাকেন ২৪ বছরের এই যুবতীও। ব্যতিক্রম একটি লাল বাস। মুম্বইয়ের জনবহুল রাস্তায় ‘বৃহনমুম্বাই ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট’(বিইএসটি )-এর ছয়টন বিশিষ্ট একটি লাল বাস চালান প্রতীক্ষা।

যদিও এ ব্যাপারে বিইএসটির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা জানান, বিইএসটি থেকে তাঁদের নিজেদের চালকদের এবং ব্যাক্তিগত ভাবে ‘কীভাবে বাস চালাবেন’ নামে একটি ২১ দিনের কোর্স করানো হয়। ড্রাইভিং স্কুলে যেমন প্রশিক্ষন দেওয়া হয়, ঠিক তেমনই প্রশিক্ষন দেওয়া হয় এখানে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ভারী যানবাহনের লাইসেন্স প্রাপ্ত হওয়ার জন্য প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত চালকদের রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট অফিসে পাঠানো হয়।

এ প্রসঙ্গে আরও পরিষ্কার হওয়ার জন্য তাঁরা জানান, “প্রতীক্ষা বিইএসটি‘র চালক নন। মিডিয়া ভুল তথ্য সরবরাহ করছে যে, প্রতীক্ষা এখানকার বাস চালক। এটা ঠিক নয়। উনি ব্যক্তিগত ভাবে এখান থেকে প্রশিক্ষন নিয়েছেন, কোনোভাবেই উনি আমাদের কর্মচারী নন। ব্যক্তিগত ভাবে প্রশিক্ষন নেওয়ার জন্য নিজেই আবেদন জানান প্রতীক্ষা। এমনকি প্রশিক্ষন নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ফি-ও দিতে হয় তাকে। আমাদের চালক হওয়ার জন্য কোনোরকম আগ্রহ দেখাননি তিনি। আমাদের কর্মচারী হওয়ার জন্য আমরাও কোনোরকম আবেদন করিনি তাকে।“

ক্লাস এইটে পড়ার সময়ই মামার মোটরসাইকেলে ‘ড্রাইভিং’-এ হাতেখড়ি হয় প্রতীক্ষার। মোটরসাইকেল আয়ত্তে আনতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি ছোট্ট প্রতীক্ষাকে। মাত্র দু’দিনের মধ্যেই মোটরসাইকেল চালানো শিখে ফেলেন, যা দেখে বিস্মিত হয়ে যায় তাঁর পরিবার

ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স শেষ করার পর রিজিয়ন ট্রান্সপোর্ট অফিসার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আরটিও হতে গেলে ভারী যানবাহনের লাইসেন্স প্রয়োজন। সুযোগ হাতছাড়া করতে চান নি। এই সুযোগই কাজে লাগান প্রতীক্ষা। বাস, ট্রাকের মতো ভারী যানবাহন নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষেত্রে এটাই ছিল তাঁর পক্ষে যথার্থ সময়।

বলাই বাহুল্য ততটাও সহজ ছিল না এই কাজ। সাধারণত পুরুষদেরই ভারী যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায়। একজন মহিলা বাস চালাচ্ছেন, এই দৃশ্য এখনও স্বাভাবিক নয় সমাজের চোখে। তাই এমন অসাধ্য সাধন করতে গিয়ে প্রায়শই উপেক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। “এই মেয়েটা চালাতে পারবে তো?” – এমন বহু মন্তব্যের মুখোমুখিও হতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু এ ধরণের মন্তব্যকে সযত্নে এড়িয়ে নিজের কাজে ব্রতী হয়েছেন প্রতীক্ষা। সমাজের বেঁধে দেওয়া এই ‘বাঁধা’ নিয়মকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে ভুল প্রমান করেছেন ২৪ বছরের এই তরুণী। এহেন নজির গড়ায় তাঁর এই কৃতিত্ব ইতিমধ্যেই নজর কেড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ার। অধিকাংশ সময়ই বাস যাত্রীরা তাঁকে বাস চালাতে দেখে অবাক হন এবং সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন তাঁর দিকে। এঁদের এড়াতে তাই এসব ঘটনাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চুপচাপ বাস চালিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে যাত্রীদের পৌঁছে দেন প্রতীক্ষা।

প্রথম প্রথম বাঁক নেওয়ার সময় ও লেন পরিবর্তন করার সময় ভালোই বেগ পেতে হত তাঁকে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরো ব্যাপারটিকেই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন তিনি। আর এখন তো দক্ষতার সঙ্গে নিয়মিত বাস চালিয়ে জীবিকা অর্জন করে থাকেন মহারাষ্ট্রের এই বাসিন্দা

একটি সাক্ষাতকারে ভারী গাড়ীর প্রতি বিশেষ ভালোবাসার কথা জানিয়ে তিনি বলেছেন, প্রায় ছয় বছর ধরে এই স্বপ্ন কে বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিলেন। প্রথম থেকেই ইচ্ছে ছিল ভারী যানবাহনগুলিকে দক্ষতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করার। মামা’র মোটরসাইকেল দিয়ে শুরু হয় সেই অভিযান এবং শেষে তা বাস, ট্রাকের মতো ভারী যানবাহনে গিয়ে থামে।

এদিকে বাইকার হিসেবেও বিশেষ সুখ্যাতি রয়েছে প্রতীক্ষার। ২০১৯ এশিয়া রোড রেসিং চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেছেন। এছাড়া অতীতেও হন্ডা, টিভিএস-এর মতো বৃহৎ সারির প্রতিষ্ঠানগুলির তরফ থেকে আয়োজিত রেসগুলিতে অংশগ্রহণ করে দু’বার ছিনিয়ে এনেছেন ‘টিভিএস রেসিং চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি’

নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে প্রতীক্ষা এখন বলেন,  আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম আর এখন এখানে দাঁড়িয়ে আমি। আসলে, প্রত্যেকেই তাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারে, শুধু মনকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে সেই লক্ষ্যে।

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...