সন ২০২০।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন বছর হয়ত আগে আর আসেনি। যার আগে বিশেষণ হিসেবে মানুষ শুরু থেকেই বসিয়ে দিয়েছে ‘অভিশপ্ত’ শব্দটা। যে বছরের প্রায় শুরু থেকেই মানুষ নিস্তার পেতে চেয়েছে ২০-র গেরো থেকে। তাদের কথায় বিষ-বিশ।
মুখে মুখে ফিরেছে ‘বিশের বিষ’। শুরু থেকেই নিঃস্ব আর রিক্ত করে চলেছে। একটার পর একটা মাস পেরিয়ে ডিসেম্বর যত কাছে এসেছে, ক্যালেন্ডারে বছরের দিন যত কমেছে তত যেন খুশি হয়ে উঠেছে মানুষ। বর্ষবরণের চেয়েও এবছর উচ্ছ্বাস বেশি ‘বর্ষশেষ’ ঘিরে।
যেন কী এক দেওয়াল ভাঙার আনন্দ। অতিমারীর কালো দিনগুলো মনেপ্রাণে ভুলতে চাওয়া।
হাহাকার, যন্ত্রণা, অনিশ্চয়তার অন্ধকার সরিয়ে বুক ঠুকে বাজি রাখা নতুন আগামীর জন্য।
কিন্তু ২০২০-এর প্রাপ্তিটুকুকে অস্বীকার করতে পারা যায় কি? সে তালিকাও যে বড় কম নয়!
এই বছরটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে শিখিয়ে যাচ্ছে অনেক কিছু! শিকড়ে কাছে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গোটা মানব সভ্যতাকে। দেখিয়ে দিয়েছে যূথের জোর। বেঁচে থাকতে মানুষ লাগে। হাতের সঙ্গে হাত মিললে তবেই এগোয় চাকা। লকডাউনের বিপন্নতায় গড়ে ওঠা ‘কমিউনিটি সার্ভিস’ বুকের বল হয়ে ফিরে এসেছে। এ যেন সেই আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ বাঁচার অনুভূতি।
কোভিড শিখিয়েছে স্বাস্থ্যের দায়। মানুষের কাছে এবং বিজ্ঞানের কাছে। মারণ অস্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি জীবনদায়ী ওষুধের আবিষ্কার। উন্নত চিকিৎসা পরিকাঠামো।
বহু বছর ধরে বহু আন্দোলন, বহু চর্চাতেও যে কথা বুঝতে পারেনি মানুষ, ক্ষমতার আস্ফালনকেই শ্রেষ্ঠত্বের সংজ্ঞা ভেবে এসেছে সেই ধারণাকে খানখান করে দিয়েছে একটা অনুস্য অনু ভাইরাস!
করোনার উৎস খুঁজতে গিয়ে চীনকে ব্যান করতে হয়েছে প্যাঙ্গোলিন হত্যা। ফ্রান্স বন্ধ করেছে বন্যপ্রাণ হত্যা। ২০১০ সালের তুলনায় কেনিয়ায় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে সিংহের সংখ্যা। বেড়েছে হাতি আর বিপন্ন শিম্পাঞ্জির মোট সংখ্যাও।
লকডাউনে শুনশান ফাঁকা রাস্তায় হরিণ, পাখি, নদীতে ডলফিন, ট্র্যাফিকহীন শহরে ফিরে আসা পাখিদের কলতান বারবার মানুষকে নে করিয়ে দিয়েছে এই পৃথিবীটা যতটা মানুষের ঠিক ততটাই ওদেরও।
বদলে গিয়েছে ‘হিরো’র সংজ্ঞা। গল্প-কাহিনীতে পড়া সুপার-হিরোরা বইয়ের পাতায় কেউ থাকে না। তারা থাকে আমাদেরই চারপাশে। আমাদের মধ্যেই। দেখা দেয় ডাক্তার, নার্স আর ওষুধের সন্ধানে সব ভুলে ল্যাবরেটারিতে দিন কাটানো বিজ্ঞানীদের বেশে। বিপদ সামলানো পুলিশ হয়েও।
বিশ্ব জুড়ে বদলে গিয়েছে কাজের ধরন। ‘ ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ নতুন কাজের সংস্কৃতি। মাইক্রোসফট, টুইটার, ইনফোসিসের মতো সংস্থাগুলোও এই পথে হেঁটেছে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, পরীক্ষা সব এখন অনলাইনে।
বিষাদ বছরে আলোর রেখা কম নয়। পৃথিবীজুড়ে বিজ্ঞান গবেষণা বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে ভারতীয় নাম। ভারতীয় মুখ।
স্ট্যান্ডফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিশ্বের করা সেরা বিজ্ঞানীদের তালিকায় ১৫০০ ভারতীয় বিজ্ঞানী জায়গা করে নিয়েছেন। কোভিড গবেষণায় চন্দ্রাবলী দত্ত চেনা নাম।
ইসরোর রোবট মানবী ‘ব্যোমমিত্র’ পাড়ি দিয়েছে চাঁদে।
২০২০-তে দুনিয়া ঘরবন্দী হলেও দ্রুত হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। ডিজিটাল বিপ্লব ঘটেছে। রাতারাতি। বদলে গিয়েছে দিশা। বিনোদন দুনিয়া থেকে খেলা সব কিছুতেই লেগেছে সেই বিপ্লবের ঢেউ। সেই বদলের সঙ্গে দ্রুত নিজেকে বদলে নিয়েছে আম জনতা।
সময় চলে নিজের গতিতে। সভ্যতাও থেমে থাকে না। ছোট-বড় ঢেউয়ের ধাক্কা বদলে দেয় সভ্যতার গতিপথ। অভিযোজন ঘটে। বেঁচে থাকার সংগ্রামে টিকে থাকতে নিজেকে বদলে নেয় জীব। কথাতেই তো আছে ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’। অতিমারী শুধু সেই বদলের অনুঘটকমাত্র।
মহৌষধির আশ্বাসে শুরু হোক নতুন বছর। একুশের স্বপ্নে লাগুক নবযৌবনের রোদ।
মাস্ক ঢাকা জীবনের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসুক বন্ধুর হাসিমুখ, এইটুকু আশা...