পৃথিবীর প্রাচীনতম পুথিগুলোর মধ্যে বহাল তবিয়তে পঞ্জিকাও রয়েছে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে মিশরের যে বৃহৎ পঞ্জিকাটি রয়েছে, সেটি সঙ্কলিত হয়েছিল দ্বিতীয় রেমেসিসের আমলে, ১২৯০ থেকে ১২২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। বৈদিক ভারতে বিস্তৃত পঞ্জিকার কথা কিন্তু জানা যায় না। ঋষিরা শুধু বার-মাস-বছর ও নক্ষত্রের অবস্থানের হিসেব রাখতেন। সাংকেতিক ও সংক্ষিপ্ত, শুধুমাত্র নিজেদের জন্য। তার ভিত্তিতেই তাঁরা যজ্ঞ ও পূজানুষ্ঠান করতেন। ফলে, সে পঞ্জিকা সাধারণের কাছে অপরিহার্য ছিল না, সুলভও ছিল না।
পঞ্জিকাকে সাধারণের কাছে অপরিহার্য করে তোলার কৃতিত্বই বলুন কিম্বা কারসাজি, তার একমাত্র দাবীদার ষোড়শ শতকের নবদ্বীপবাসী স্মার্ত রঘুনন্দন ভট্টাচার্য। তিনি স্মৃতিশাস্ত্রের কূটকচালিতে বার-তিথি-উপোস-পালন-পারণ-সংস্কারে ধর্মভীরু বাঙালিকে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেললেন যে, এসব 'নিত্য কর্মে' ভীষণভাবে প্রয়োজন হল 'পঞ্জিকা'র।
নবদ্বীপ তখন বাংলার সাংস্কৃতিক রাজধানী। সেখানকার সমস্ত জ্যোতিষ-পণ্ডিতেরা এ-সময় থেকেই সারা বছরের শুভাশুভ, মাস, বার, তিথি, রাশি ফল, শুভ ও অশৌচ কর্মের সময় নির্ণয় করে সংকলন করতে শুরু করলেন। সেটা তুলোট-খাগে পুথি লেখার যুগ। অত পাঁজি-পুথি লিখবেই বা কে, পড়বেই বা কে! ফলে, উদ্ভব হল একশ্রেণীর মধ্যজীবী ব্রাহ্মণের। তাঁরা নবদ্বীপের জ্যোতিষী-ভটচাযদের কাছ থেকে বার-তিথির বিধিনিষেধ, পর্ব-পার্বণের কর্তব্যকর্ম জেনে নিয়ে পয়সার বিনিময়ে গেরস্তের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বিধান দিতে শুরু করলেন। এই চলমান পঞ্জিকাদের নাম দেওয়া হল, ‘দৈবজ্ঞ’। দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই পেশা রমরমিয়ে চলল।
তারপর শুরু হল জল মেশানো। অনেক ভটচায এসময় তাঁদের পোষ্য দৈবজ্ঞের ওপর গণনা বিষয়ে নিজের নিজের মত চাপাতে শুরু করলেন। ফলে, পঞ্জিকায় বৈষম্য দেখা দিল। এতে পঞ্জিকা-অনুসারী রাজ-কাজেও গোঁজামিল শুরু হল। তখন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমল। ব্যাপারটা তাঁর চোখ এড়াল না। তিনি এই বৈষম্যের নিষ্পত্তি করতে নবদ্বীপের ভটচায-পণ্ডিতদের ডেকে একসঙ্গে বসিয়ে গণনা করালেন। তারপর সহমতের ভিত্তিতে একটি পঞ্জিকা সংকলন করালেন। সংকলন করলেন সেকালের বিখ্যাত পণ্ডিত রামচন্দ্র বিদ্যানিধি। সভার লিপিকারদের দিয়ে সেই পঞ্জিকার বেশকিছু কপি তৈরি করিয়ে কৃষ্ণচন্দ্র স্থানীয় জমিদার, বড়লোক, পণ্ডিতদের মধ্যে বিতরণ করলেন। এই সময় থেকেই নবদ্বীপ-সংলগ্ন অঞ্চলের এক শ্রেণীর মানুষ নতুন বছরের পঞ্জিকা কপি করে, সাধারণের কাছে বিক্রি করতে শুরু করল। পঞ্জিকার সূচনায় ঋণস্বীকার করে লেখা হতে লাগল, ‘রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুমত্যানুসারে’ বা ‘নবদ্বীপাধিপতির অনুমত্যানুসারে’ পঞ্জিকাটি রচিত হল। ছাপার যুগেও প্রথম দিকে অনেকদিন এই ঋণস্বীকারের প্রথা চালু রইলো।
১৭৭৮ সালে হ্যালহেডের লেখা বাংলা ব্যাকরণ ছাপা হয়েছিল হুগলির জন অ্যানড্রুজের ছাপাখানায়। বঙ্গে ছাপা এটিই প্রথম বই, যাতে ইংরেজির সঙ্গে ছাপার হরফে স্থান পেয়েছিল বাংলা ভাষা। তবে, প্রথম বাংলা পঞ্জিকা ছাপা হতে লেগে গেল আরও চল্লিশটা বছর। ছাপা হল ১৮১৮ সালে। কলকাতা থেকে। এই পঞ্জিকার সঙ্কলক ছিলেন কলকাতার জোড়াসাঁকোর দুর্গাপ্রসাদ নামের এক ব্যক্তি। আর প্রকাশ করেছিলেন রামহরি নামের কেউ। এঁদের দুজনেরই পুরো নাম জানা যায় না।
পঞ্জিকা ছাপা হতেই 'দৈবজ্ঞ'-র পেশায় যেমন সঙ্কট ঘনিয়ে এলো, তেমনি কিছু মানুষ নতুন পেশা খুঁজেও পেল। তখন তো বইয়ের দোকান ছিল না, তাই তারা ঝাঁকা ভরে পঞ্জিকা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় বিক্রি শুরু করে দিল। সেকালের হিসেবে দাম বেশ চড়াই ছিল, প্রতি কপি এক টাকা। তবু, মানুষ যেন হাতে চাঁদ পেল; বুঝল, একখানা পঞ্জিকা বাড়িতে থাকলে দৈবজ্ঞ বা ভটচায--কারও মুখ চেয়ে বসে থাকতে হবে না। ফলে, হু হু করে বিক্রি হতে লাগল। লাভের গন্ধ পেয়ে অনেকেই এগিয়ে এলেন পঞ্জিকা প্রকাশনায়। এতে একটা জিনিস ভালো হল, প্রতিযোগিতার বাজারে সবাই তাঁদের পঞ্জিকায় নতুন নতুন আকর্ষণীয় বিষয় সংযোজন করতে লাগলেন। সেই নবত্বের একটা তালিকা করা যেতে পারে :
পঞ্জিকায় দেব বা দেবীর ছবির একটি ব্লক ছাপার রীতি প্রথম থেকেই ছিল। কিন্তু, ১২৪২ বঙ্গাব্দে গঙ্গাগোবিন্দ বিদ্যালঙ্কার সঙ্কলিত পঞ্জিকায় সেই দেবদেবীদের ছবির সংখ্যা বাড়ল। জ্যোতিষগণনা ও বার্ষিক রাশিফলের পাশাপাশি ভারতের বিভিন্নস্থানের পৌরাণিক ও ভৌগোলিক বিবরণ প্রথম ছাপা হল এই পঞ্জিকাতেই।১২৬১ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত একটি পঞ্জিকায় প্রথম গঙ্গার জোয়ার ভাঁটার সময়সূচী ছাপা হল। বাংলা হিন্দু-পঞ্জিকার প্রচার দেখে উৎসাহিত হয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য ‘বৃহৎ মহম্মদীয় পঞ্জিকা’ প্রকাশ করলেন মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ। ১২৯৯ বঙ্গাব্দে। এতে মুসলিম রাজাদের বিবরণ আর স্টিমারের টাইম টেবিল ছাপা হল।
খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জন্য প্রথম ‘খ্রিস্টীয় পঞ্জিকা’র প্রকাশ হল কলকাতা ট্যাকট সোসাইটি ও চার্চ অব ইংলন্ড-এর যৌথ প্রচেষ্টায়, ১৮৪৯ সালে। এতে সংযোজিত হল, বিভিন্ন মেলা, কৃষির বিবরণ আর নানান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সরকারী ছুটির দিনের তালিকা।
বাংলা পঞ্জিকার ইতিহাসে ১২৭৬ বঙ্গাব্দ থেকে শুরু হল, ডাইরেক্টরি পঞ্জিকার যুগ। দুর্গাচরণ গুপ্ত প্রতিষ্ঠিত গুপ্তপ্রেস প্রকাশিত ‘গুপ্তপ্রেস ডাইরেক্টরি পঞ্জিকা’। ১৮৮৮ সাল থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করল ‘পি এম বাগচীর পঞ্জিকা’। এর সঙ্গে রাখা হল একটি, ডাইরেক্টরি। এতে স্থান পেল জেলার বিবরণ, চাকরির খবর, কলকাতার রাস্তার সুলুকসন্ধান, সরকারি বিভিন্ন বিভাগের ঠিকানা, যোগাযোগের উপায়, স্কুল-কলেজ, চিকিৎসক ও জ্যোতিষীদের ঠিকানা।
পঞ্জিকার পাতাতেই দেড়শ বছর আগে শুরু হয়েছিল সচিত্র বিজ্ঞাপন ছাপানোর রেওয়াজ। এমনি করেই নানান বিষয়কে অঙ্গে ধারণ করে দুশো বছরের বেশি সময় ধরে কাঠখোদাই আর লিথো ছবির অলংকরণে আরও বৈচিত্র্যময় ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে বাংলা ছাপা পঞ্জিকা। ভারতের প্রতিটি প্রদেশেরই নিজস্ব পঞ্জিকা আছে, কিন্তু বাংলা পঞ্জিকার মতো এত বৈচিত্র্য আর কোথাও নেই।
তথ্য ঋণঃ চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়