সংবিধানের পনেরো নারী

সংবিধানের আনাচে কানাচের অনেক ইতিহাসই সকলের জানা। তবে কারা এই পাঁচ নারী!সেদিন নাকি প্রাসাদোপম সরকারি অফিসের ছাঁতের কাচ ভেঙেছিল। হয়ে চলেছিল দেশের আগামী সুনিশ্চিত করার নিরলস প্রক্রিয়া।উপস্থিত ছিলেন ২৯৯ জন সভ্য ।  এর মধ্যেই ছিলেন পনেরো জন মহিলা। কয়েকজন এসেছিলেন সরাসরি নির্বাচিত হয়ে। কয়েকজন আবার নিজ নিজ রাজ্যের প্রতিনিধি হিসাবে।

একবার চিনে নেওয়া যাক এঁদের-

দক্ষয়নি ভেলায়ুধান

nari1

বয়স তখন ৩৪।বৈঠকের কনিষ্ঠ ছিলেন তিনিই। কোচিনের পুলায়া সম্প্রদায়ের তিনিই একমাত্র উচ্চ শিক্ষিতা ও বিধানসভার সদস্যা।  গান্ধী ও আম্বেদকর অনুরাগী এই মহিলা তাঁদের মতামত কে চ্যালেঞ্জ ছুড়তেও হননি পিছপা। একটি নির্দিষ্ট জাতীয় পরিচয়- এটাই ছিল তাঁর রাজনৈতিক অভিমত। মানতেননা সংরক্ষণ। স্বপ্ন দেখতেন এমন এক দেশের যেখানে অচ্ছুত  শব্দটির থাকবেনা কোণও প্রাধান্য। 

আম্মু স্বামীনাথন

nari2

জন্মেই আগুন পেয়েছিলেন রক্তে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে আসে বিয়ের প্রস্তাব।কিন্তু তার আগে পাত্র পক্ষের সামনে রেখেছিলেন নিজের কিছু সর্ত।মাদ্রাজে সম্পূর্ণ করেছিলেন ইংরাজী শিক্ষা।১৯১৪ তে আসা রাজনীতিতে। ১৯১৭ তে গঠন করেছিলেন নিজের দল উইমেন্স’ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন। জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান ১৯৩৪ এ। বি আর আম্বেদকর এর সঙ্গে পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায় গুলির জন্য লড়েছেন অনেকটা পথ। 

হন্সা জিভরাজ মেহ্‌তা

nari3

মানবাধিকার আইনের এক নম্বর অনুচ্ছেদে লিখিত ছিল পৃথিবীর সকল পুরুষ সমান অধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে জন্মেছে । পুরুষ অর্থেই  সকল মানুষকে বোঝানো হয়েছিল। তবুও সংশোধন করতে হয় সে অলিখন। পুরুষ পাল্টে হয় মানুষ। ব্যবহার করা হয়েছিল মেন  শব্দটির বদলে হিউমান্স । এই পরিবর্তনের কাণ্ডারি ছিলেন একজনই- হন্সা।১৮৯৭ এ জন্ম। হন্সা লেখাপড়া সম্পূর্ণ করেছিলেন বিলেতে। হেঁটেছিলেন স্বদেশী ও অসহযোগ আন্দোলনে। ’৪৭ এর ১৫ই অগস্ট দেশের প্রথম ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা উড়েছিল তাঁর হাতেই। 

লীলা রায়

nari4

জন্ম ১৯০০ তে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ। শুরু করেছিলেন দীপালি সংঘ।  একটি সংগঠন যেখানে নারী দের সামাজিক ও রাজনৈতিক শিক্ষার পাঠ দেওয়া হত। লেখার হাতও ছিল পটু।১৯৩১ এ শুরু করেছিলেন জয়শ্রী। মহিলা দ্বারা লিখিত, সম্পাদিত ও পরিচালিত প্রথম ম্যাগাজিন। ১৯৪৬ এর সংবিধান অধিবেশনে বাংলা থেকে নির্বাচিত তিনিই ছিলেন একমাত্র মহিলা।দেশ বিভাগের প্রতিবাদ স্বরূপ নিজের সদস্যা পদ থেকে দিয়েছিলেন ইস্তফা।

দুর্গাবাঈ দেশমুখ

nari5

অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার সময় বয়স ছিল মাত্র বারো। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে নিবেদিত প্রাণ দিয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে।১৯৩৬ এ তাঁর হাতেই তৈরি অন্ধ্র মহিলা সভা। এক দশকের মধ্যেই গোটা মাদ্রাজে শিক্ষার একমাত্র পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল সেই প্রতিষ্ঠান।’৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দলনের সময় উনি ওকালতি করছিলেন মাদ্রাজ কোর্টে। 

বেগম অ্যায়জাজ রসুল

nari6

১৯৩৭ এ উত্তর প্রদেশ বিধানসভার ভোটে অসংরক্ষিত সিটে জিতে ছেড়েছিলেন পর্দার আড়াল। সংবিধান রচনার বৈঠকে তিনিই ছিলেন একমাত্র মুসলমান মহিলা।বাবা জুলফিকর আলি খাঁ –র থেকেই রাজনীতির পাঠ।১৯৫২ থেকে ’৫৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের রাজ্যসভার সদস্যা। জাতীয় মহিলা হকি সংগঠনের সভাপতি পদ সামলেছেন দীর্ঘ পনেরো বছর। নির্বাচিত হয়েছিলেন এশিয় মহিলা হকি ফেডারেশনের সভাপতি পদেও।কমলা চৌধুরীআইন অমান্য আন্দোলনের সময় সবথেকে বেশী চর্চিত রাজনীতিক মহিলা কর্মী। ১৯৩০ এ আন্দোলন চলাকালীন বহুবার গিয়েছেন গরাদের ওপারে।১৯৪৬ এ মীরাটে অনুষ্ঠিত ৪৬ তম জাতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে নির্বাচিত হয়েছিলেন সহ সভাপতি। ’৪৭ থেকে ’৫২ সময়কালে ছিলেন সংবিধানের সদস্যা।লিঙ্গ বৈষম্য, চাষি নিগ্রহ এবং বিধবাদের করুন অবস্থান নিয়ে তাঁর কলম কথা বলেছে সবসময়।

সুচেতা কৃপালিনী

nari7

’৪৭ এর ১৪ই অগস্টের রাত।স্বাধীনতা উদযাপন। জহরলাল নেহ্রু রাখবেন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়মিত নিয়তির সঙ্গে মিলন। তবে তাঁর আগে গোটা পৃথিবী শুনেছিল এক মহিলা কণ্ঠের দৃপ্ত সুর। সারে জাহাঁ সে আচ্ছা, জন গন মন ও বন্দে মাতরম্‌- গেয়ে উঠেছিল একে একে।তিনিই সুচেতা কৃপালিনী।স্বাধীনতা সংগ্রামী, সংবিধানের সদস্যা, মুখ্যমন্ত্রী ও সর্বোপরি একজন মহিলা জন প্রতিনিধি। স্বাধীনতা সংগ্রামে সুচেতা দেবীর অবদান আজও ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল।তাঁর দৌলতেই জাতীয় কংগ্রেসের মহিলা শাখার সূচনা হয়। সত্যাগ্রহের সময় হেঁটেছেন গান্ধীজীর পদানুসরণে।মালতী চৌধুরী স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী নাম রেখেছিলেন তুফানি।  ওড়িষা থেকে নির্বাচিত সংবিধানের সদস্যা। পিছিয়ে পড়া শ্রেনী, জাতি ও গোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়নে তাঁকে আজও মনে করা হয়।পড়াশুনো বিশ্বভারতীতে।তাঁর স্বামী নবকৃষ্ণ চৌধুরী ছিলেন ওড়িষার মুখ্যমন্ত্রী। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই অবদান রেখেছেন সত্যাগ্রহ আন্দোলনে। ওড়িষার স্থানীয় পিছিয়ে পড়া জাতির উন্নয়নে তাঁর সংগঠন বাজিরত ছত্রভাষ  এর অবদান অনস্বীকার্য।পূর্ণিমা ব্যানার্জি’৩০-’৪০ এর দশকে উত্তর প্রদেশ থেকে উঠে আসা স্বাধীনতা সংগ্রামের জোয়ারের একমাত্র নেত্রী। সংবিধান অধিবেশনে তাঁর মুক্ত কণ্ঠের ভাষণ আজও সকলে মনে করে।সত্যাগ্রহ ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় গরাদেই ছিল তাঁর আবাস। সেখানেই সম্পূর্ণ করেছিলেন ব্যাচেলরের ডিগ্রী।

সরোজিনী নাইডু

 nari8 

ভারতের নাইটিংগেল। জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম মহিলা সভাপতি। দিল্লির রাজ্যপালও ছিলেন একসময়।বিলেত থেকে পাঠ সম্পূর্ণ করে সরাসরি যোগ দিয়েছিলেন অসহযোগ আন্দোলনে। গরাদের মুখ দেখেছেন বহুবার। ১৯১৪ তে রয়্যাল সোসাইটির সদস্যা হন। ১৯১৭ তে মন্তেগু-চেমস্‌ফোর্ড  বৈঠকে তিনিই ছিলেন মহিলা প্রতিনিধি।

রাজকুমারী অমৃত কৌড় 

nari9

১৯২৭ এ অনুষ্ঠিত সর্ব ভারতীয় মহিলা সম্মেলনের এক পুরোধা। একজন মানবতাবাদী যিনি পীড়িতদের জন্যে ছিলেন সদা জাগ্রত।ভারতের টিউবারকিউলসিস অ্যাসোসিয়েশন, সেন্ট্রাল লেপ্রসি ইন্সটিটিউট এর প্রতিষ্ঠাত্রী ও রেড ক্রস লিগের সদস্যা। পর্দা প্রথা ও বাল্য বিবাহ নিয়েও ছিলেন সরব।স্বাধীন ভারতের প্রথম মহিলা ক্যাবিনেট মন্ত্রী। ১৯৫৬ সালে এ আই আই এম এস বিল পাশের পিছনে একমাত্র কাণ্ডারি ছিলেন এই অমৃত।অ্যানি মাস্‌কারিন সংবিধান অধিবেশনে তিনি সরব হয়েছিলেন মৈত্রী তন্ত্র নিয়ে। ছিলেন কোচিন নির্বাচনী অধিবেশনের সদস্যা। লোকসভার  অধিবেশনে তিনিই ছিলেন প্রথম স্বাধীনভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধি।

বিজয়লক্ষী পণ্ডিত

nari10

জহরলাল নেহ্রুর বোন হওয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নিজের স্বকীয় পরিচিতি। একজন ভয়াল স্বাধীনতা সংগ্রামী। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় গিয়েছিলেন গরাদে।ভারতের প্রথম মহিলা ক্যাবিনেট মন্ত্রী। জাতি সংঘের সাধারণ অধিবেশনে তিনিই ছিলেন এশিয়ার প্রথম মহিলা সভাপতি।রেনুকা রায় সুখের জীবন নয়, বেছেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের কাঁটা ছড়ানো রাস্তা। বাবা ছিলেন সিভিল অফিসার। পড়াশুনো করা বিলেতে। তারপর জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান।নারীর সমান অধিকার নিয়ে লড়েছিলেন সংবিধানের অধিবেশনে।  ছিলেন একজন সক্রিয় রাজনীতি কর্মী।’৪৩-’৪৬ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সভার সদস্যা, তারপর সংবিধান অধিবেশন এবং শর্তাধীন সরকারের সদস্যা। আর ১৯৫২-’৫৭ সময়কালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ও ত্রান এবং পুনর্বাসন দপ্তরের মন্ত্রিত্ব সামলেছিলেন। ’৫৭ এবং ’৬২ সালে মালদা লোকসভা থেকে ছিলেন নির্বাচিত প্রার্থী।আজকের তারিখে সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে নারীবাদের অনেক কিস্‌সাই আমাদের গোচরে আসে।তবুও এত দশক আগের এই সকল জীবন বৃত্তান্ত আজকের নারী সমাজের কাছে আদপেই কিংবদন্তী।  

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...