"তুই একটা বিরাট বটগাছের মত হবি। তোর ছায়াতলে এসে সমাজের আর্ত পীড়িত মানুষ ঠাণ্ডা হবে।” বিশ্বজয়ী বিবেকানন্দকে এই কথাগুলো বলেছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। তখনও তিনি বিবেকানন্দ নামে পরিচিতি পাননি। তিনি তখন সিমলে পাড়ার দত্তবাড়ির বড় ছেলে, নরেন্দ্রনাথ দত্ত।
দুরারোগ্য রোগের যন্ত্রনা ভুগতে ভুগতে জীবনের শেষ মুহূর্তের জন্য অপেক্ষারত ঠাকুর নিজের প্রিয়তম শিষ্যকে যে বৃহৎ বটবৃক্ষের কথা বলেছিলেন, তার অঙ্কুরোদ্গম হতে সময় লেগেছিল আরও ১১টা বছর। ১ মে, ১৮৯৭। স্থান, বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়ি। ১২৫ বছর পূর্ণ করল রামকৃষ্ণ মিশন। বহুজনের হিতে ১৮৯৭ সালের ১ মে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের ভাবধারা ও তাঁর ভক্তি আন্দোলনকে বিশ্বজুড়ে প্রচার করতে, স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৭ সালের ১ মে বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়িতে ষোলো জন সদস্যদের নিয়ে একটি সভা করেছিলেন। সেখানে তিনি প্রস্তাব করেন সংঘ ব্যতীত বড় কোনও কাজ হয় না। তাঁর এই বক্তব্য সবাই সমর্থন করেন। চার দিন পর অর্থাৎ ৫ মে এই সংঘের নামকরণ হয় রামকৃষ্ণ মিশন অ্যাসোসিয়েশন।
বরাহনগর মঠ
তারপর নানান আইনি জটিলতা পেরিয়ে, অনেক লড়াই সংগ্রাম করে ১৯০৯ সালে আইনি স্বীকৃতি পায় রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন। ততদিনে চলে গিয়েছেন স্বামীজি। ঠাকুরের যে আদর্শ তা সারা বিশ্বময় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য স্বামীজী যে সংঘের স্বপ্ন দেখেছিলেন তার বীজ বপন হয়েছিল সেইদিনই। রামকৃষ্ণ মিশন স্থাপিত হয়েছিল, যে সংস্থা ঠাকুরের আদর্শ ও ঈশ্বর-ভাবনা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার রূপকার। যে স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বামীজি, তা পূরণ হয়েছে। ভারতের কাছে আজ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন গৌরবের এবং গর্বের। ১৮৯৭ সালের ১ মে স্বামী বিবেকানন্দের নেতৃত্বে উত্তর কলকাতায় বলরাম বসুর বাড়িতে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হয়। তাই ওই দিনটিকেই রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে মনে করা হয়। ওইদিনই ঠাকুরের পুণ্যভস্মচূর্ণ, যেটি 'আত্মারামের কৌটো' হিসেবে খ্যাত, যাকে ঘনিষ্ঠ রামকৃষ্ণ ভক্তশিষ্য 'শ্রীজি' বলেও উল্লেখ করেন, সেটিকে নতুন ঠাকুরবাড়িতে এনে ষোড়োশোপচারে শ্রীশ্রীঠাকুরের পূজো ও হোম করা হয়েছিল। হয়েছিল অন্নভোগ। বিকেলে স্বামীজি কলকাতা ফিরে গিয়েছিলেন।
তবে ১ মে তারিখটাকে খানিকটা প্রতীকীও ধরা যেতে পারে। কত দিনের ভাবনা যে একে পরিপুষ্ট করেছিল তার ইয়ত্তা নেই। ১ মের পরেও অনেক পটপরিবর্তন হয়েছিল। সে সবই ইতিহাস। ১৮৯৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। স্বামীজি সেদিন সমবেত সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, ''আপনারা আজ কায়মনোবাক্যে ঠাকুরের পাদপদ্মে প্রার্থনা করুন যেন মহাযুগাবতার ঠাকুর আজ থেকে বহুকাল 'বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়' এই পুণ্যক্ষেত্রে অবস্থান করে একে সর্বধর্মের অপূর্ব সমন্বয়কেন্দ্র করে রাখেন।'' এ প্রার্থনা, বলাইবাহুল্য, শ্রীরামকৃষ্ণের নামাঙ্কিত মঠ ও মিশনের প্রতিষ্ঠাকল্পেই।
এখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে রামকৃষ্ণ মিশন। ২০২১ সাল পর্যন্ত বিশ্বে জুড়ে ২৪ দেশে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ২৫০টিরও বেশি শাখা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। পৃথিবী জুড়ে মোট ৭৪৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের সেখানে দুই লক্ষেরও বেশি বিদ্যার্থী পড়েন। বেদান্ত শিক্ষা তো রয়েছেই, তার সঙ্গে আধ্যাত্মিকতা নিয়েও চর্চা হয়ে চলেছে।
নীলাম্বর মুখার্জীর বাগান বাড়ির মঠ
রামকৃষ্ণ মঠের সূচনা হয়েছিল বহু আগেই। রোগাক্রান্ত ঠাকুরের সেবা করতে করতেই সংঘের জন্ম। ঠাকুর চোখ বোজার পরপরই তাঁর প্রিয় নরেন, রাখাল, লাটু, তারক, বাবুরাম, শরৎ, শশী, কালী এবং আরও অনেকে মিলে বরাহনগরের এক ভাঙাচোরা বাগানবাড়িতে শুরু করেন রামকৃষ্ণ সংঘের যাত্রা। সম্বল বলতে ঠাকুরের আশীর্বাদ আর সংঘজননী শ্রী শ্রী সারদার ইচ্ছে। এই বরাহনগর মঠই আজকের রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ভিত্তি। এই বরাহনগর মঠই সেই মূল বটবৃক্ষ, যার অন্যতম প্রধান শাখা নতুনভাবে বেলুড়ের জমিতে অঙ্কুরিত হয়ে আজকের মহাবটবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। যা গোটা বিশ্বকে ছায়া প্রদান করছে।
স্বামী প্রভানন্দ লিখেছিলেন -- ''বলা যেতে পারে, দক্ষিণেশ্বর যদি হয় রামকৃষ্ণভাবধারার 'গোমুখ', বেলুড়মঠ সে ভাবধারার 'গঙ্গোত্রী'''! নিরন্তর আনন্দধারার মতো নির্গত রামকৃষ্ণভাবধারাই হল রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন যা অমেয় অমৃত!
ঠাকুরের কাছে মা তাঁর সন্তানদের জন্য করুণ গভীর প্রার্থনা জানাতেন; বলতেন, তাঁর সন্তানরা কি এভাবে এলোমেলো ঘুরে বেড়াবেন, এ জন্যই কি তাঁর (ঠাকুরের) আসা? ছেলেরা কি তাঁদের গুরুর নামে এক ছাদের তলায় একজোট হতে পারবে না? একইরকম মনোবাসনা ছিল নরেন্দ্রনাথেরও। ঠাকুরের নামে একটা জমি কিনে সেখানে ঠাকুরের মন্দির প্রতিষ্ঠা করে সর্বমানবের কল্যাণসাধনের লক্ষ্যে এক প্রতিষ্ঠান তৈরি তাঁর স্বপ্ন ছিল; ছিল তীব্র জেদ ও সঙ্কল্প।
রামকৃষ্ণ মন্দির, বেলুড়
বিশ্ববিখ্যাত বিবেকানন্দের দেশি ও বিদেশি ভক্তগণের মধ্যে বেশ কাছের যাঁরা, তাঁরা স্বামীজির এই লক্ষ্যের খবর রাখতেন। সকলেই সকলের মতো চেষ্টা করতেও চাইতেন। কিন্তু টাকা এবং টাকা ছাড়া আরও নানা সমস্যা উদ্ভূত হত। ফলে বিষয়টায় ক্রমশ দেরি হয়ে যাচ্ছিল। তবে অস্থায়ী মঠ প্রথম থেকেই ছিলই; বরানগর, আলমবাজার, কাশীপুর, বেলুড়ে গঙ্গাতীরস্থ নীলাম্বরবাবুর বাগানবাড়ি ইত্যাদি গুরুভাইদের জন্য নানা সময়ে নানা সঙ্ঘবদ্ধতা বা সঙ্ঘজননীর অস্থায়ী আশ্রয় তো ছিলই। কিন্তু একেবারে খাঁটি অর্থে নিজের ঠাঁই তো ছিল না। অনাগত দিনে যাঁরা ঠাকুরের নামে ঘর ছাড়বেন, তাঁরা কোথায় এসে উঠবেন?
ফলত, নানা সময়ে নানা চেষ্টাচরিত্র হয়েছে। সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়েছিল কাঁকুড়গাছির যোগোদ্যান নিয়ে। কিন্তু সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহীভক্ত রামচন্দ্র দত্তের প্রতাপ। সাধুসন্ন্যাসীদের জন্য একটি আশ্রয়ের প্রয়োজন ছিলই। নীরবে নিভৃতে ঠাকুরের নামাঙ্কিত মঠ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সন্ন্যাসীদের তরফে জারি ছিল সংগ্রাম।
এরই ফলশ্রুতিতে ১৮৯৭ সালের ১ মে কলকাতার বাগবাজারস্থিত বলরাম বসুর বসতবাটী, যেটি পরবর্তীকালে 'বলরামমন্দির' হিসেবে খ্যাত, সেখানেই আনুষ্ঠানিকভাবে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা করেন স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ। বাড়িটির এখন যেখানে ঠাকুরের পুজো হয়, অর্থাৎ মন্দির এবং তারই সঙ্গে সংলগ্ন প্রার্থনা, গান, ধ্যান, সভার জন্য নির্দিষ্ট অংশ, সেই লম্বা হলঘরে এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। মঠ মিশনের গড়ে ওঠার স্মরণীয় ইতিহাসে সাক্ষী বলরাম বসুর ঐতিহ্যবাহী এই বাড়িটি। আজ বিশ্বময় বিপুল গৌরবে ছড়িয়ে পড়া বিপুলকায় রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সংক্ষিপ্ত শুরুটা সেদিন ঘটেছিল একেবারে খাস উত্তর কলকাতায়।
স্বামীজি প্রথম থেকেই এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সুর বেঁধে দিয়েছিলেন-'আত্মনো মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ'। নিজের মুক্তি এবং জগতের কল্যাণসাধন। আজও রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন এক অনন্য অটল সঙ্ঘ হিসেবে জ্বলজ্বল করছে। ১২৫টি বছর তার পক্ষে হয়ত সামান্যই! ঠাকুরের আশীর্বাদে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বিজয়পতাকা আরও উড়তে থাকুক, এটাই প্রার্থনা।