একবার ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তা নিয়ে বিবাদে বাঁধে। তাদের নিরস্ত করার জন্য শিব ত্রিভুবনকে ভেদ করে জ্যোতির্লিঙ্গ নামে এক বিশাল অন্তহীন আলোকস্তম্ভ রূপে আবির্ভূত হন। বিষ্ণু ও ব্রহ্মা এই তার উৎস অনুসন্ধান করতে যান। ব্রহ্মা যান উপর দিকে এবং বিষ্ণু নামেন নিচের দিকে।
কিন্তু তারা কেউই এই লিঙ্গের জে পাননা। ব্রহ্মা মিথ্যা বলেন যে তিনি উৎসটি খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু বিষ্ণু তার পরাজয় স্বীকার করে নেন। শিব তখন একটি দ্বিতীয় জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে আবির্ভূত হয়ে মিথ্যা বলার জন্য ব্রহ্মাকে শাপ দেন যে অনুষ্ঠানে তার কোনও স্থান হবে না। অন্যদিকে সত্য কথা বলার জন্য তিনি বিষ্ণুকে আশীর্বাদ ক্করে বলেন যে সৃষ্টির অন্তিমকাল পর্যন্ত তিনি পূজিত হবেন। জ্যোতির্লিঙ্গ হল সেই অখণ্ড সর্বোচ্চ সত্যের প্রতীক, যার অংশ শিব নিজে। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরগুলিতে শিব স্বয়ং অগ্নিময় আলোকস্তম্ভ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
দেশে শিবের নানা নামের অসংখ্য মন্দির ছড়িয়ে রয়েছে। কোথাও তিনি মূর্তি কোথাও তিনি লিঙ্গদেব। স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গগুলির মধ্যে আচার্য শংকর তাঁর পরিব্রাজক জীবনে যে যে মন্দিরে বিশেষ দর্শন ও অনুভূতি লাভ করেছেন, সেগুলিকে তিনি দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ হিসাবে নির্বাচিত করে গিয়েছেন।
হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, শিব অরিদ্রা নক্ষত্রের রাত্রিতে প্রথম জ্যোতির্লিঙ্গ রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। শিবপুরাণের শতরুদ্র সংহিতায় (অধ্যায় ৪২। ২-৪) দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের নাম ও অবস্থানের উল্লেখ আছে।
মহাশিবরাত্রিতে এই মন্দিরগুলিতে বিশেষ শিব আরাধনা অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর রুদ্রাভিষেক হয়।
শিবরাত্রি তিথির প্রাক্কালে জেনে নিন সেই দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের কথা
সোমনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ, গুজরাট- গুজরাট রাজ্যের সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের বেরাবলের প্রভাস ক্ষেত্রে এই মন্দির অবস্থিত। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম। সোমনাথ শব্দটির অর্থ “চন্দ্র দেবতার রক্ষাকর্তা”। সোমনাথ মন্দিরটি ‘চিরন্তন পীঠ’ নামে পরিচিত।হিন্দু পুরাণ অনুসারে, দক্ষকে প্রজাপতি অভিশাপ দেন। অভিশাপমুক্ত হতে চন্দ্র প্রভাস তীর্থে শিবের আরাধনা করেন, শিব তাঁর অভিশাপ অংশত নির্মূল করেন। এই কারণে চন্দ্র সোমনাথে শিবের একটি স্বর্ণমন্দির নির্মাণ করেন। পরে রাবণ রৌপ্য ও কৃষ্ণ চন্দনকাষ্ঠ দ্বারা মন্দিরটি পুনর্নিমাণ করেছিলেন বলে বিশ্বাস।
মল্লিকার্জুন জ্যোতির্লিঙ্গ, অন্ধপ্রদেশ- অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীশৈলমে কৃষ্ণা নদীর তীরে মল্লিকার্জুন জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির অবস্থিত। এই মন্দির ১৮টি মহাশক্তিপীঠের একটি। কথিত আছে মল্লিকার্জুনে সতীর উপরোষ্ঠ পড়েছিল।
মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ- মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী শহরে রুদ্রসাগর হ্রদের তীরে অবস্থিত মহাকালেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির। এই মন্দিরের শিবলিঙ্গটি শিবের স্বয়ম্ভু রূপ মনে করা হয়। মহাকালেশ্বরের মূর্তিটি দক্ষিণমূর্তি নামে পরিচিত। ‘দক্ষিণামূর্তি’ শব্দের অর্থ ‘যাঁর মুখ দক্ষিণ দিকে’। হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, এই মন্দিরের প্রধান উপাস্য দেবতা শিব অনন্তকাল ধরে উজ্জয়িনীর শাসক। দুশন নামের এক রাক্ষসের হাত থেকে উজ্জয়িনীবাসীদের মুক্তি দেওয়ার পর থেকে শিবকে এখানে মহাকালেশ্বর রূপে পুজো করা হয়। শিবরাত্রিতে মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
ওঙ্কারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ- ওঙ্কারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির মধ্যপ্রদেশের খাণ্ডোয়া জেলায় অবস্থিত। মন্দির সৃষ্টির ইতিহাস নিয়ে একাধিক জনশ্রুতি আছে। পুরাণ গাথা বলে, বিন্ধ্যাচল পর্বতমালার রক্ষক শূর বিন্ধ্য নিজ পাপ স্খলনের জন্য মহাদেবকে প্রসন্ন করেন৷ তিনি পবিত্র জ্যামিতিক নকশার মাধ্যমে বালি ও পলির মিশ্রণে একটি শিবলিঙ্গ তৈরী করেন৷ ভগবান শিব তার তপস্যায় প্রসন্ন হন এবং দুটি রূপে তার সামনে প্রকাশিত হন৷ মনে করা হয় ঐ দুটি রূপই যথাক্রমে ওঙ্কারেশ্বর এবং অমরেশ্বর।
কেদারনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ, উত্তরাখন্ড- উত্তরাখন্ডে গাড়োয়াল হিমালয়ের কোলে অলকানন্দা ও মন্দাকিনীর তীরে কেদারনাথ শহরে কেদারনাথ মন্দিরের অবস্থান। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম। এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল কেদারখণ্ড; তাই এখানে শিবকে কেদারনাথ বলা হয়। মানুষের বিশ্বাস শিব এই অঞ্চলের অধিপতি। মহাভারতে উল্লেখ আছে কেদারনাথের। পাণ্ডবরা এই স্থানে তপস্যায় সন্তুষ্ট করেছিল শিবকে।
বিশ্বনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ- কাশী বিশ্বনাথ মন্দির অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির। ধর্মনগরী কাশীতে শিব ভক্তদের ‘ভোলানাথ’, ‘বিশবনাথ’, ‘বিশ্বেশ্বর’। পবিত্র গঙ্গার তীরে বিশ্বনাথ মন্দির। কথিত আছে কৈলাসের পর মর্ত্যে এই শিবের আপন ভূমি। স্কন্দ পুরাণের কাশীখন্ডে কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরের উল্লেখ আছে।
ভীমাশংকর জ্যোতির্লিঙ্গ, মহারাষ্ট্র- মহারাষ্ট্রে তিনটি জ্যোতির্লিঙ্গের অবস্থান। তার মধ্যে অন্যতম ভীমাশংকর জ্যোতির্লিঙ্গ। পুণে থেকে ১০০ কিমি দূরে এই মন্দিরের অবস্থান। এখানে লিঙ্গরাজ ভক্তদের মধ্যে ‘মটেশ্বর মহাদেব’ নামেও পরিচিত। ভীম নামের এক দানবের হাত থেকে ভক্তদের রক্ষা করেন শিব। তারপরই শিবের আরাধনার জন্য গড়ে ওঠে পুণের এই মন্দিরের জ্যোর্তিলিঙ্গ।
ত্রিম্বাকেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ, মহারাষ্ট্র- মহারাষ্ট্রের নাসিক থেকে ৩০ কিমি দূরে গোদাবরীর তীরে অবস্থিত ত্রিম্বাকেশ্বর মন্দির। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম। কালো পাথরে তৈরি মন্দিরে ভগবান শিবের অধিষ্ঠান। শোনা যায় স্ত্রী অহল্যাকে নিয়ে মহর্ষি গৌতম মহারাষ্ট্রের এই স্থানে বাস করতেন। সেখানে নদী নিয়ে আসার জন্য শিবের কাছে প্রার্থনা জানান ঋষি৷ তারপরই তাঁর সেই প্রার্থনা পূরণ করেন মহাদেব। সেই কাহিনিকে স্মরণ করেই শিবের ত্রিম্বকেশ্বর মন্দির স্থাপিত হয়েছে।
বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ, ঝাড়খন্ড- বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির ঝাড়খন্ডের দেওঘর অঞ্চলে অবস্থিত। কথিত আছে, রাবণ শিবকে খুশি করার জন্য তপস্যা এই স্থানে তপস্যা করেছিলেন। তিনি তার দশটি মাথা একটি একটি করে কেটে যজ্ঞের আগুনে আহুতি দিচ্ছিলেন। শিব সন্তুষ্ট হয়ে স্বয়ং আসেন রাবণকে সুস্থ করে তুলতে। শিব যেহেতু এখানে বৈদ্য বা চিকিৎসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তাই এখানে শিবকে বলা হয় বৈদ্যনাথ।
শিবপুরাণের কোটিরুদ্র সংহিতায় বৈদ্যনাথ জ্যোতির্লিঙ্গের উল্লেখ আছে।
নাগেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ, গুজরাট- গুজরাটের জামনগরে অবস্থিত নাগেশ্বর মন্দির। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম। শিব উপাসকরা নাগেশ্বর মন্দির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ। দৌরাকা রাক্ষসের হাত থেকে ভক্তকে রক্ষা করার পর শিবের মহিমার আরাধনায় স্থাপিত হয় নাগেশ্বর মন্দির।
রামেশ্বরম জ্যোতির্লিঙ্গ, তামিলনাড়ু- দক্ষিণ ভারতের বিখ্যাত শৈব তীর্থক্ষেত্রের নাম রামেশ্বরম। এই শিব লিঙ্গ শ্রীরামনাথস্বামী হিসাবে পরিচিত। এই তীর্থ দ্বাদশ জ্যোতিলিঙ্গের মধ্যে অন্যতম। কথায় বলে, কাশীর বিশ্বনাথজির দর্শনে যে পুণ্য লাভ হয় শ্রীরামেশ্বরের দর্শন ও পূজায় সমপরিমাণ পুণ্য লাভ হয়। কাশীযাত্রার ফল সম্পূর্ণ রূপ পায় রামেশ্বর যাত্রায়। এখানে শিবের দুটি লিঙ্গ রয়েছে। একটি লিঙ্গ পুজা করতেন সীতা, অন্যটি হনুমান দ্বারা পুজিত হত বলে কথিত রয়েছে। রাবণকে পরাজিত করে, এসে এখানেই শিবের আরাধনা করেন রাম। সেই থেকে রামেশ্বরমে শিবের দুটি জ্যোর্তিলিঙ্গ স্থাপিত আছে।
ঘৃষ্ণেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ, মহারাষ্ট্র- ঘৃষ্ণেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির বা ঘুশ্মেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির হল হিন্দু দেবতা শিবের পবিত্রতম বারোটি জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরের অন্যতম। মহারাষ্ট্রের আওরাঙ্গাবাদ ও দৌলতাবাদের কাছে মন্দিরটি অবস্থিত। শিবপুরাণের কোটিরুদ্র সংহিতার ৩২ ও ৩৩তম অধ্যায়ে এই জ্যোতির্লিঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়।
কথিত আছে, বেরুলের শিবভক্ত উপজাতি-প্রধান ঘৃষ্ণেশ্বরের কৃপায় এখানে গুপ্তধনখুঁজে পেয়েছিলেন। এই টাকায় তিনি মন্দিরটির সংস্কার করান ও শিখরসিঙ্গনপুরে একটি হ্রদ প্রতিষ্ঠা করেন। গৌতমীবাল ও অহল্যাবাই হোলকারও ঘৃষ্ণেশ্বরের মন্দির সংস্কার করিয়েছিলেন। এই মন্দিরকে কুসুমেশ্বর মন্দিরও বলা হয়।
তথ্যঃ(ভ্রমণসঙ্গী)